‘আমাদের সময়ে ভালো সিনেমা করার প্রতিযোগিতা ছিল’
স্বর্ণালি দিনের সিনেমার নায়ক সোহেল রানা। অসংখ্য সুপারহিট সিনেমা করে আজও মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছেন। ৫০ বছর আগে তিনি মাসুদ রানা সিনেমায় নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এ ছাড়া দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা 'ওরা ১১ জন'র প্রযোজকও তিনি। ছাত্রজীবনে ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতা। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও তিনি।
২১ ফেব্রুয়ারি তার জন্মদিন। দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফেলে আসা জীবনের অনেক কথা বলেছেন সোহেল রানা।
দ্য ডেইলি স্টার: নিঃসন্দেহে বলা যায়—আপনার সময়ে স্বর্ণালি দিনের সিনেমা ছিল...
সোহেল রানা: স্বর্ণালি শব্দটার গভীরতা অনেক বেশি। স্বর্ণালি বলব না, ভালো সিনেমা তৈরি হতো—সেটা বলব। আমি মনে করি, শুধু স্বর্ণালি দিনের সিনেমা নয়, সব কিছুই তখন স্বর্ণালি ছিল। আমাদের সময় স্বর্ণালি মানুষ ছিল। স্বর্ণালি পৃথিবী ছিল। স্বর্ণালি সময় ছিল। সবকিছুই স্বর্ণালি ছিল আমাদের সময়ে।
ডেইলি স্টার: আপনারা বেশ কজন নায়ক জনপ্রিয় ছিলেন সেই সময়ে, সবার সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন ছিল?
সোহেল রানা: আমরা পরস্পরকে ভালোবাসতাম, সম্মান করতাম, কাজেই সুসম্পর্ক ছিল আমাদের মধ্যে। আমাদের সময় ভালো কাজ করার, ভালো সিনেমা করার প্রতিযোগিতা ছিল। সবাই পরিশ্রম করতাম। সবাই ভালো কাজের পেছনে ছুটতাম। কিন্তু আমরা ছিলাম বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব সারাজীবন রয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, আমাদের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ভালো সিনেমা করার প্রতিযোগিতা ছিল আমাদের সময়ে।
ডেইলি স্টার: ২১ ফেব্রুয়ারি বিশেষ দিনে জন্মদিন, কেমন লাগে এই দিনে?
সোহেল রানা: খারাপ লাগে, ভাবি—জীবন থেকে একটা বছর চলে গেল। জীবন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়টা খুব ভাবায়। আবার ভালো লাগে যখন মানুষের ভালোবাসা পাই। বিশেষ দিনকে আমি সম্মান জানাই। ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাই।
ডেইলি স্টার: জন্মদিন ঘিরে মানুষের ভালোবাসা পাওয়াটা কীভাবে দেখেন?
সোহেল রানা: ইতিবাচকভাবেই দেখি। জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য আমার সময়ের খুব বেশি মানুষ বেঁচে নেই। তারপরও আপনজনরা, কাছের মানুষরা শুভেচ্ছা জানায়। তারকাখ্যাতি পাওয়ার পর অনেকবার জন্মদিনে গেছে। ভালোবেসে অনেকেই এসেছেন। এখন এই দিনে দোয়া চাই। ভালোবাসা চাই। আর কিছু চাই না। এখন তো নতুন করে মানুষের মন জয় করতে পারব না। সত্যি কথা বলতে দিনটিকে আলাদা করে দেখি না। প্রতিটি দিন আমার কাছে একই।
ডেইলি স্টার: এই বয়সে এসে চাওয়া কী?
সোহেল রানা: সুস্থ থাকা। একবার ভয়াবহ অসুখে পড়েছিলাম। আল্লাহ সুস্থ করেছেন। এখন চাওয়া হচ্ছে যে কয়টা দিন আছি, সুস্থ থাকতে চাই। সুস্থভাবে বাঁচতে চাই। সুস্থতার চেয়ে বড় কিছু নেই। সেটাই চাই।
ডেইলি স্টার: আপনার সময়ের অনেকেই চলে গেছেন। তাদের কথা কতটা মনে পড়ে?
সোহেল রানা: আমার সময়ের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। অভিনয় জগতের, রাজনৈতিক জগতের অনেকেই নেই। তবে, স্মৃতি আমাকে কাতর করে রাখে না। কেননা, ও তো চলে গেছে, আমাকেও চলে যেতে হবে। আমিও সারাজীবন পারব না। এটাই নিয়ম। তারপরও স্মৃতির মধ্যে কিছু সুখস্মৃতি আছে। কিছু দুঃখের স্মৃতিও আছে। অত্যন্ত হৃদয়ের কাছাকাছি যারা ছিল, তারাও চলে গেছে। তাদের কথা মনে তো পরবেই। হয়তো চুপচাপ বসে আছি, অলস সময় পার করছি, তখনেই মনে পড়ে।
ডেইলি স্টার: জন্মদিনকে কেন্দ্র করে কোন স্মৃতিটা বেশি মনে পড়ে কিংবা ভাবায়?
সোহেল রানা: আমি যখন প্রথম ফিল্মে আসি, আমার এক বন্ধু আছে, ছেলেবেলার বন্ধু, সেই সময় থেকে শুরু করে আজ ৫০ বছর ধরে মনে রেখেছে। বাবার কাছ থেকে সে টাকা নিয়ে কেক আনত। তার ছেলে-মেয়ে হয়ে গেছে। তাদের বিয়ে দিয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠিত। সে আজও আমার জন্মদিনটাকে মনে রেখেছে। আমার কাছে আশ্চর্য ব্যাপার লাগে। জন্মদিনে সকালবেলা সে আসে। কিছু খায় না। কেক নিয়ে আসে। খাওয়ার কথা বললে সে একটু আচার চায়। এত লং টাইম আমাকে ভালোবেসে আসছে। এটা ভাবায়। সারাবছর টেলিফোনও করে না। একদিন সে আসবেই। এই স্মৃতিটা ভুলতে পারব না।
ডেইলি স্টার: নায়ক হিসেবে খ্যাতি পাওয়ার পর প্রেমের চিঠি কেমন পেতেন?
সোহেল রানা: চিঠি পেতাম। প্রচুর চিঠি পেতাম একজীবনে। প্রেমের চিঠিও পেতাম। প্রতিটি চিঠি পড়তাম। ভালো লাগত। মজা পেতাম। প্রকাশভঙ্গী ভালো না লাগলে তা পড়তাম না। কেউ কেউ তো সেই সময়ে দেখা করার জন্য বাসায় কিংবা শুটিংয়ে চলে আসত। জানতে চাইতাম—বাসা খুঁজে পেলেন কীভাবে। আমার বাসার নাম খেয়া। আশপাশে তখন বাসা ছিল না। উত্তরায় এসেই পেয়ে যেতেন।
ডেইলি স্টার: প্রেমের গুঞ্জন শোনা গেলে কী করতেন?
সোহেল রানা: প্রেমের গুঞ্জন কখনো শুনিনি। দেখুন, আমার বিপরীতে কে নায়িকা হবেন, তা কাস্টিং করতেন প্রোডিউসার। টেবিলের মধ্যে আলোচনা হতো আমাদের সময়ে। রাজ্জাক-কবরী জুটি অনেক ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। তখন তাদের নিয়েও হয়তো কিছু কথা প্রচার হতো। দুয়েকজনের সম্পর্কে হতো। আমাকে নিয়েও হয়নি, তা নয়। কিন্তু সেটা প্রেমের গুঞ্জন নয়। আমরা যখন কাজ করতাম, সহশিল্পীকে সহকর্মী মনে করতাম। একসঙ্গে কাজ করেছি। শুটিং শেষ, সে চলে গেল, আমিও চলে গেলাম। ওইরকম সম্পর্ক কখনো হয়নি।
কক্সবাজারে আউটডোরে শুটিং করতে গেলে অবসরে একটু চা বা কফি খেতে যেতাম। ব্যস, এটুকুই। ধরুন, আপনি যেখানে কাজ করেন, সেখানে সবার সঙ্গে তো হৃদ্যতা হয় না। কারও কারও সঙ্গে হয়। সাগর পাড়ে শুটিং করতে যেতাম। রিপোর্টারও নিয়ে যেতাম। সে হয়তো এসে লিখে দিলো, সোহেল রানা ও অমুক সাগর পড়ে সূর্যাস্ত দেখলেন। সেই লেখার মধ্যে শৈল্পিক বিষয়টি ছিল। শালীনতা ছিল।
ডেইলি স্টার: অভিনয় নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে?
সোহেল রানা: না। আল্লাহ আমার ভাগ্যে যতটুকু লিখে রেখেছিলেন, ততটুকুই করেছি।
Comments