‘তিস্তার ভাঙন হামাকগুলাক শ্যাষ করি দ্যাইল’

মালেকা বেওয়া
মালেকা বেওয়া। ২৬ আগস্ট ২০২২। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

৬৩ বছর বয়সী মালেকা বেওয়া স্বামী আব্দুল গফুরকে হারিয়েছেন ১০ বছর আগে। সংসার জীবনে তিনি ১৩ বার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ গত ১৫ আগস্ট তিনি ভাঙনের কবলে পড়েন।

মালেকার ২ ঘরের একটি চলে গেছে তিস্তার উদরে। অপরটি স্থানীয়দের সহায়তা ভেঙে অন্যের জমিতে রেখেছেন।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের পূর্ব কালমাটি গ্রামে তিস্তাপাড়ের মালেকা বেওয়ার দিন কাটছে অবর্ণনীয় কষ্টে।

মালেকা বেওয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত কয়েক বছরে আমাদের ১২ বিঘা আবাদি জমি ও বসতভিটা তিস্তায় বিলীন হয়েছে। শেষ সম্বল বসতভিটাও চলে গেছে নদীর উদরে। ২ ঘরের একটি তিস্তায় ভেসে গেছে। একটি ঘর অন্যের জমিতে রেখেছি।'

তিস্তার ভাঙন
লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের পূর্ব কালমাটি গ্রামে তিস্তার ভাঙন। ২৬ আগস্ট ২০২২। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

তিনি আরও বলেন, 'তিস্তার ভাঙন হামাকগুলাক শ্যাষ করি দ্যাইল। এ্যালা আর হামারগুলার কিছুই নাই। এ্যালা হামার বাস্তুভিটা নাই, ঘর নাই। হামারগুলার ঘরোত খাবারও নাই।'

একই গ্রামের মোন্নাফ মিয়া (৫৮) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তিস্তার ভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে এখন গৃহহীন। অন্যের জমিতে ঘর তুলে রেখেছি। জমি কিনে বসতভিটা করার সামর্থ্য নেই।'

'তিস্তার উদরে আবাদি জমি, ফলের বাগান ও বসতভিটা বিলীন হয়েছে। চরম দরিদ্রতার মধ্যে আছি। আগে স্বপ্ন দেখতাম সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার। এখন দেখি কোনরকমে বেঁচে থাকার।'

'হামরাগুলা এ্যাকনা ইলিপ পাই। হামরা ইলিপ চাই না। হামাকগুলাক তিস্তার ভাঙন থাকি বাঁচান। তিস্তাপাড়ে বাঁধ দ্যান,' যোগ করে তিনি।

তিস্তার দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একই গ্রামের নবির হোসেন (৬৫) জানান, গত কয়েক বছরে ভাঙনে ১৫ বিঘা আবাদি জমি ও বসতভিটা হারিয়ে তিনি নিঃস্ব হয়েছেন। তার সর্বশেষ ৫ শতাংশের বসতভিটাও তিস্তার পেটে চলে গেছে। পরিবারের লোকজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়ের বাড়িতে।

তিনি আরও বলেন, 'হামরাগুলা খালি শুনি আইসবার নাগছি তিস্তা নদীপাড়োত বাঁধের কাজ কইরবে সরকার। এইল্যা খালি শুইনবারে নাইকছি। কোনদিন কাজ হইবে। হামারগুলার জমি, ভিটামাটি সোগে নদীত গ্যালো?'

'আগোত মাইনসে হামার বাড়িত কাজ করছিলো। আর এ্যালা মুই মাইনসের বাড়িত কাজ কইরবার নাইকছোং। এ্যালা এ্যাকবেলা খাওয়া জোটে তো আর এ্যাকবেলা না খ্যায়া থাকা নাগে।'

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসন সূত্র বলছে, লালমনিরহাটের ১৮-২০টি স্থানে তিস্তা ও ধরলার ভাঙন দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও নদীভাঙন তীব্র হয়েছে।

এসব এলাকায় প্রতিনিয়ত আবাদি জমি ও বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। ভাঙন হুমকিতে আছে ৪ শতাধিক বসতভিটা ও কয়েক শ বিঘা আবাদি জমি ও কয়েকটি স্থাপনা।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভাঙনকবলিত এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করে ভাঙন ঠেকানোর কাজ চলছে। আপাতত ভাঙন রোধ করা হয়েছে। নদীতে পানি বাড়লে আবারো ভাঙন বাড়তে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান সুজন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লালমনিরহাটের দুঃখ হলো তিস্তা ও ধরলার ভাঙন। এ কারণে অসংখ্য পরিবার গৃহহীন ও নিঃস্ব হয়েছে। ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোকে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।'

'স্থায়ীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ভাঙনে নিঃস্ব পরিবারের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'তিস্তাপাড়ে স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।'

তার মতে, 'তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন তা তিস্তাপাড়ের লাখো মানুষের দাবি।'

Comments

The Daily Star  | English
Election Commission

EC’s accountability is key to Bangladesh’s electoral reform

Success of wider electoral reforms depends heavily on the EC’s willingness to adopt reforms.

9h ago