ভূমিকম্প ঝুঁকি, কোথায় আছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশে ভূমিকম্প প্রবণতা, মোকাবিলা ও পরবর্তীতে করণীয় নিয়ে বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

একেরপর এক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে তুরস্ক ও সিরিয়া। আজ সোমবার ভোরে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ১২ ঘণ্টা না পেরোতেই ৭ দশমিক ৭ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এতে ২ দেশেই প্রাণহানির সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে প্রতি ১০ মিনিটে মরদেহ বের করে আনছেন উদ্ধারকারীরা।

কোনো স্থানে ভূকম্পনের জন্য ফল্ট লাইনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ভূত্বকের বিশাল খণ্ডকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে থাকা ফাটলকে ফল্ট লাইন বলা হয়। ফল্ট লাইন দিয়ে ২ প্লেটের সংঘর্ষ হলে ভূমিকম্প হয়।

আজকের প্রথম ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপ্রাকৃতিক দিক থেকে অস্থিতিশীল এক অঞ্চলে। এখানে রয়েছে পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট। তুরস্কের দক্ষিণ–পূর্ব সীমান্তের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম বরাবর এই ফল্টের অবস্থান। পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে বহু আগে থেকেই খুবই বিপজ্জনক উল্লেখ করে সতর্ক করে আসছিলেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা।

তেমনি বাংলাদেশের মূল ভূ-ভাগসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় এরকম মোটামুটি ৫টি চ্যুতি (ফল্ট) আছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ভূমিকম্প প্রবণতা, মোকাবিলা ও পরবর্তীতে করণীয় নিয়ে বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।

অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, 'তুরস্ক-সিরিয়ার মতো বাংলাদেশও ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। আমাদের এখানে মোটামুটি ৫টি ফল্ট লাইন আছে। ১৮৯৭ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি ফল্ট লাইনে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সীমান্ত এলাকায় এরকম আরও ২-৩টি ফল্ট লাইন আছে। দেশের ভেতরেও বঙ্গবন্ধু সেতুর আশপাশে এবং নোয়াখালীতে এরকম ফল্ট লাইন আছে।'

'আমাদের এখানেও ঐতিহাসিকভাবে ১৮৭০ থেকে শুরু করে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তুরস্কের মতো বা এর চেয়ে বড় ধরনের, যেমন- ৭ দশমিক ৫ ও ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। তুরস্কের ভূমিকম্পগুলোকে সে তুলনায় ছোটই বলা যায়। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ১৫০-২৫০ বছর। ১৭৬২ সালে আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সাইকেল হিসেবে সেটি এখনো ফিরে আসেনি। এরপর ১৮৮৫ সালে একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটা হয়ত আরও ১০-২০ বছর পর হতে পারে। এরকম ১৫০-২৫০ বছরের যে সাইকেল আছে, সেটি কখন হবে কেউ জানে না। ফলে তুরস্কও ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করতে পারেনি। আসলে ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করা সম্ভব না। তবে ব্যবস্থা একটাই, প্রস্তুতি নিতে হবে', বলেন তিনি।

বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, 'এক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড এনফোর্সমেন্টকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে ৯৯ শতাংশ নতুন ভবন টিকে যায়। তবে পুরনো ভবনের জন্য মজবুতিকরণ পন্থায় যেতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- তুরস্ক আমাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত। তারা ভূমিকম্প আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্গত এলাকায় তল্লাশি ও উদ্ধারকারী বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছে, হেলিকপ্টারে করে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে। তুরস্কের সব ভবন তো আর ভালো নয়, যেগুলো ভেঙেছে সেগুলোর বেশিরভাগই ২-৩ তলার, তবে আশপাশে বহুতল ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে।'

'তবে আমাদের রেসপন্ডিং ক্যাপাসিটি কতটুকু সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। কেননা এক রানা প্লাজায় উদ্ধারকাজ চালাতেই আমাদের ১৫ দিন লেগে গেছে। এরকম একাধিক ভবন যদি বিধ্বস্ত হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু, একটি ভূমিকম্প না হলে আমরা নিজেদের যাচাই করতে পারব না। আমাদের সরকার বিভিন্ন সময় ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীকে প্রচুর সরঞ্জাম কিনে দিয়েছে। আমি এবং জামিল স্যার (অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী) এ ধরনের বিভিন্ন কমিটিতে কাজ করেছি। অন্তত ২০০ কোটি টাকার সরঞ্জাম বিভিন্ন কমিটিকে আমরাই কিনে দিয়েছি', যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, 'তবে সমস্যা হলো- সেসব সরঞ্জাম ব্যবহার না করার ফলে নষ্ট হওয়ার অবস্থা। কারণ এসবের চর্চা হয় না। আরেকটা বিষয় হলো- স্থানীয় কমিউনিটিকে ক্ষমতায়ন করার কথা বলেছিলাম আমরা, ফায়ার সার্ভিস যাতে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের অফিসে কিছু সরঞ্জাম রেখে দেয়। কারণ আমাদের শহরগুলোতে শুধু চিপা গলি আর গলি, তুরস্ক ও সিরিয়ার রাস্তাঘাট কিন্তু এমন না, বেশ চওড়া এবং সহজেই যেকোনো জায়গায় পৌঁছানো যায়। আমাদের পুরান ঢাকায় যদি ভূমিকম্প হয়, দেখা যাবে কোনো গাড়িই সেখানে ঢুকতে পারবে না। সে কারণে স্থানীয় কমিউনিটিকে ক্ষমতায়ন করে কিছু সরঞ্জাম তাদের কাছে রেখে দিলে এবং নিয়মিত চর্চা করলে ভালো হতো। নইলে এই ইস্যুগুলো আমাদের জন্য একসময় কাল হয়ে দাঁড়াবে।'

'আমাদের এখানে বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না, এটাও একটা বড় ইস্যু। ১৯৯৬ সাল থেকে যেহেতু আমাদের বিল্ডিং কোড আছে, সেহেতু এই সময়ের পর থেকে নির্মিত বহুতল ভবনগুলো ভালো অবস্থায় থাকবে বলে বিশ্বাস করি। তবে আমাদের পুরনো ২-৩ বা ৫ তলার যেসব ভবন আছে, যেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেগুলো যদি বিধ্বস্ত হয়, সেক্ষেত্রে প্রথমত এখনই সেগুলোকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, উদ্ধারকাজের জন্য নিয়মিত কিছু মহড়া করে করে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। সরঞ্জাম কেনা আছে, কিন্তু সেগুলো গত ১০ বছর ধরে ব্যবহৃতই হচ্ছে না। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময় অল্প কিছু ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর হয়নি। এটা আমাদের জন্য বড় ধরনের এক চ্যালেঞ্জ', বলেন তিনি।

এই ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ বলেন, 'রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আমাদের প্রস্তুতি কিছুটা ভালো ছিল, সেসময় অনেক সরঞ্জাম কেনা হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি হচ্ছিল। কিন্তু গত ১০ বছরে তেমন কোনো দুর্যোগ হয়নি বলে আমরা প্রায় ভুলে গেছি। এই সময়ে দেশে ভূমিকম্প নিয়ে কোনো প্রজেক্ট হয়েছে, মোকাবিলার জন্য আমরা কোনো প্রস্তুতি নিয়েছি বা মহড়া (মকড্রিল) করেছি, আমাদের মহল্লাভিত্তিক কমিউনিটিকে যে ক্ষমতায়ন করার কথা, সেসব আমি কোথাও দেখিনি।'

'আমাদের এখানে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) রয়েছে, যা প্রায় পুরোটাই কমিউনিটি ভিত্তিক। এর মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকায় স্থানীয় কমিউনিটিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং তারাই সাইক্লোনের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে ডেকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেন। আমাদের মহল্লায় মহল্লায়ও এরকম ভূমিকম্প প্রস্তুতি কর্মসূচি করা দরকার। কেননা প্রাথমিক উদ্ধারকাজ কমিউনিটির লোকেরাই করেন। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী যাওয়ার আগেই তারা কাজ শুরু করে দেন। সেজন্য প্রথম সাড়াদানকারী তৈরি করা প্রয়োজন', বলেন তিনি।

অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, 'বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাংলাদেশে ভূমিকম্প নিয়ে তেমন কেউ কোনো কাজ করে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান বা প্রাইভেট সেক্টরে কিছুই নেই। যদিও ২০০১ সালে আমরা বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। জামিল স্যার সভাপতি এবং আমি প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলাম। এরপর থেকে আমাদের কাজ ভালোই চলছিল। তবে ২০১৬ সালের দিকে একজন সরকারি যুগ্ম-সচিব সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হতে এর কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের কাছ থেকে নিয়ে নেন। এরপর এই প্রতিষ্ঠানের আর কোনো খবর নেই।'

'জামিল স্যারের ছত্রছায়ার থেকে আমি অনেকদিন ধরে কাজ করেছি, গবেষণা করেছি। তবে কষ্টটা হলো- আমরা যে এতো গবেষণা করলাম, বিভিন্ন সময় সরঞ্জাম কিনে দিলাম, এগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা বা চর্চা ধরে রাখার যে মানসিকতা বা ইনস্টিটিউশনাল মেমোরি কোনো কিছুই ঠিক নেই। আমরা যা দেখেছি তা হলো- সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে নতুন নতুন লোক আসেন, পুরনো কথা তারা সব ভুলে যান। আবার শূন্য থেকেই শুরু করেন। এই ইনস্টিটিউশনাল মেমোরি ও তার প্রয়োগ, বিল্ডিং কোড এনফোর্সমেন্ট এবং আমরা যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সুপারিশ করেছিলাম, সেগুলোর বাস্তবায়ন কোনোদিনই হয়নি', বলেন তিনি।

বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, 'যারা এসব নিয়ে কাজ করেন, তাদের সঠিকভাবে ব্যবহার না করা গেলে কোনো লাভ নেই। আমরা যত টাকাই খরচ করি না কেন, কেনো ফল আসবে না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরকেই এসব বিষয় দেখার কথা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন পদে যারা আসেন, তারা অন্য অধিদপ্তর, বিভাগ বা মন্ত্রণালয় থেকে স্বল্প সময়ের জন্য আসেন, ফলে আগে কী হয়েছে, তা তাদের স্মরণেই থাকে না। আমি মনে করি, ভূমিকম্প নিয়েই সরকারের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত, যে প্রতিষ্ঠান শুধু এ বিষয়টি নিয়েই কাজ করবে।'

Comments