এলএনজি সেক্টরেও বাড়তি সক্ষমতা, বাড়বে ক্যাপাসিটি চার্জ

বাংলাদেশের এই দশকের শেষ নাগাদ এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তর করার সক্ষমতা চাহিদার তুলনায় বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাড়তি সক্ষমতার মতোই উদ্বৃত্ত এই সক্ষমতা গলার ফাঁস হয়ে উঠতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএমআই রিসার্চ।
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের এই দশকের শেষ নাগাদ এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তর করার সক্ষমতা চাহিদার তুলনায় বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাড়তি সক্ষমতার মতোই উদ্বৃত্ত এই সক্ষমতা গলার ফাঁস হয়ে উঠতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএমআই রিসার্চ।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের দুটি ভাসমান স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তরের) আছে। সামিট ও এক্সিলারেট গ্রুপ পরিচালিত এই এফএসআরইউ দুটির মাধ্যমে আমদানি করা এলএনজি গ্যাসে রূপান্তরিত করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। এই দুটি ইউনিটের বার্ষিক রিগ্যাসিফিকেশন ক্ষমতা ৭৬ লাখ টন।

তবে সরকার আরও চারটি এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্পের পরিকল্পনা করছে। একটি মাতারবাড়ীতে স্থলভিত্তিক টার্মিনাল হবে, যেখানে আরও ৭৬ লাখ টন (৭.৬ এমপিটিএ) এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন করা যাবে। এছাড়া মহেশখালী ও পায়রায় আরও দুটি ভাসমান টার্মিনাল হবে যার সম্মিলিত সক্ষমতা হবে আরও ৭.৬ এমটিপিএ।

এছাড়াও বর্তমানে চালু এক্সিলারেট টার্মিনালটির সক্ষমতা বাড়ানো হবে।

বাংলাদেশের তেল ও গ্যাস খাত নিয়ে বিএমআই রিসার্চ বলছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শেষ হলে চলমান দশক শেষ হওয়ার আগেই অতিরিক্ত ২ কোটি ১০ লাখ টন রিগ্যাসিফিকেশন সক্ষমতা পাবে বাংলাদেশ।

বিপরীতে ২০২৩ সালে কাতার এনার্জি এবং ওমান ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যথাক্রমে ১৮ লাখ টন এবং ১৫ লাখ টন এলএনজি কেনার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছে পেট্রোবাংলা। নতুন দুই চুক্তির আওতায় ২০২৬ সালে বাড়তি এলএনজি সরবরাহ শুরু হলে পেট্রোবাংলার চুক্তিবদ্ধ এলএনজি আমদানি ৬৮ লাখ টন এমটিপিএ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আনার চাপ কমবে বলে মনে করছে ফিচ সলিউশনস কোম্পানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএমআই রিসার্চ। তবে তারা এ-ও বলেছে, এলএনজি আমদানির পূর্বাভাসের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উদ্বৃত্ত এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন সক্ষমতা থাকবে।

এছাড়া পেট্রোবাংলা ভারতের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কানাই চট্টা থেকে খুলনার শ্রীরামপুর পর্যন্ত ২৭৫ কিলোমিটার আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারতের এইচ-এনার্জি থেকে ৩৮ লাখ টন গ্যাস আমদানি করতে চাইছে।

তবে গ্যাসের পর্যাপ্ত বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন না থাকাসহ নানা চ্যালেঞ্জে শেষ পর্যন্ত নতুন সব এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে কিনা তা এখনো অনিশ্চিত বলে মনে করছে বিএমআই রিসার্চ।

বিদ্যমান ৭৬ লাখ টন রিগ্যাসিফিকেশন ক্ষমতার পুরোটা কখনোই ব্যবহার করতে পারেনি বাংলাদেশ।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টন এলএনজি আমদানি করেছে। অর্থসংকটে গত অর্থবছরে এলএনজি আমদানির পরিমাণ ছিল ৪০ লাখ টন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর যেমন ক্যাপাসিটি চার্জ আছে তেমনি রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটগুলোর সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করেও একটি নির্দিষ্ট খরচ রয়েছে।

রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট অলস বসিয়ে রাখার জন্যও সরকারকে যে নির্দিষ্ট চার্জ বহন করতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, 'পেট্রোবাংলা এখন পর্যন্ত পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেনি।'

তবে এই চার্জের পরিমাণ কত, সেটি তাৎক্ষণিকভাবে বলতে পারেননি তিনি।

বাংলাদেশ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেছেন, '২০১৮ সালে এলএনজি আমদানি শুরু পর থেকে বিদ্যমান এফএসআরইউগুলো সরকার কম ব্যবহার করছে।'

কোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এসব প্রকল্প অযাচিতভাবে নেওয়া হয়েছে। কোনো টেন্ডার ছাড়াই কাউকে কাউকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে কাজ দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে বিএমআইয়ের গবেষণা বলছে, ২০১৬ সালে স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে সর্বোচ্চ ২৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ঘনমিটার (বিসিএম) গ্যাস উত্তোলন হয়েছিল। তারপর থেকে এর উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমেছে।

বিএমআই রিসার্চ বলছে, 'গ্যাসকূপ খননের অনুসন্ধান কার্যক্রমে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগের কারণে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে সংকট আরও বাড়বে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।'

উৎপাদন কমে যাওয়া ঠেকাতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পেট্রোবাংলা ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনার কথা জানায়।

কিন্তু এ বিষয়ে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিএমআইয়ের গবেষণা আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন বার্ষিক ৩ শতাংশ হারে কমবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন ২০২৮ সালের মধ্যে ২০ বিসিএম-এর নিচে নামবে বলে আশঙ্কা করেছে তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অনারারি অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, আমাদের ত্রুটিপূর্ণ নীতি আমাদের এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে যে আমরা ক্রমশ আরও বেশি এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি।

৪৬টি অনশোর গ্যাস কূপ খনন এবং অফশোর গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো অনেক দেরিতে এসেছে।

'আমরা ইতোমধ্যেই দেরি করে ফেলেছি। আমাদের অন্তত পাঁচ বছর আগে ড্রিলিং প্রকল্প শুরু করা দরকার ছিল। এসব উদ্যোগের ফল পেতে আমাদের আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে,' বলেন তিনি।

এম শামসুল আলম বলেন, বাড়তি সক্ষমতার জন্য এখানেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মতো বাড়তি টাকা খরচ হয়। দিনশেষে গ্যাসের দামও বেড়ে যায়।

শেষ পর্যন্ত ভোক্তারাই সব রকমভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে মনে করছেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এতে শুধু গ্যাসের দামই বাড়ে না, গ্যাসভিত্তিক সব পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়ে। এটি শেষ পর্যন্ত সামগ্রিক অর্থনীতিকেই প্রভাবিত করে।

Comments