বিদ্যুৎ খাত: সঞ্চালন-বিতরণে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার

‘দুই বিভাগে বরাদ্দের বিশাল ব্যবধান এটাই প্রমাণ করে যে সরকার জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা সুরক্ষিত না করেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে।’
প্রতীকী ছবি | সংগৃহীত

গ্রিড সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান কিছু সুবিধাকে আরও আধুনিক করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সুবিধার সর্বাধিক ব্যবহারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাজেটে বিদ্যুৎ বিভাগকে দেওয়া বরাদ্দের প্রায় তিন ভাগের একভাগ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশকে (পিজিসিবি) দিয়েছে সরকার।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বরাদ্দ রেখেছেন ২৯ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। এটি আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম। এর মধ্যে পিজিসিবি পাবে ১০ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।

কক্সবাজারের মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নকারী কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ পেয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ—৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে পিজিসিবি চট্টগ্রাম এলাকায় গ্রিড আপগ্রেডেশনের বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কাজগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা।

বড়পুকুরিয়া-বগুড়া-কালিয়াকৈর ৪০০ কেভি প্রকল্পকে দুই হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন সুবিধা প্রকল্পকে দেওয়া হয়েছে ৬৪৬ কোটি টাকা।

পিজিসিবির প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে শুরু হওয়া পাওয়ার নেটওয়ার্ক স্ট্রেংদেনিং প্রকল্পে সর্বোচ্চ তিন হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০০৯ সালের চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে ২০২৩-২৪ সালে হয়েছে ৩০ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট।

বর্তমানে নয় হাজার ১৪৪ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ২৭ কেন্দ্র নির্মাণাধীন। এর বেশিরভাগই বেসরকারি খাতে।

ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় খারাপ। সেখানে একটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও তা পর্যাপ্ত জ্বালানি পায় না। গ্যাস সরবরাহ উন্নয়নে শুরু হওয়া পাইপলাইন প্রকল্প বিদ্যুৎ বিভাগের বাজেট থেকে এক হাজার ৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাঁচটি বিতরণ প্রকল্প ও দুটি প্রি-পেইড মিটার সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে অর্থায়ন করবে।

টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ 'স্রেডা'কে ১১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সেচ ও সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে বরাদ্দ দ্বিগুণ বেড়ে ৩৩০ কোটি টাকা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগ প্রকল্প বিতরণ নিয়ে কাজ করছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে বাংলাদেশের রুরাল পাওয়ার কোম্পানিজ ও নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি। এই দুই প্রতিষ্ঠান রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়েকটি উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

অন্যান্য বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রি-পেইড মিটার বা আপগ্রেডেশনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার মূলত সঞ্চালন ও বিতরণ-সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আনতে পেরেছি। এখন তাদের টেকসই ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আমরা সারাদেশে স্মার্ট গ্রিড নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চাই।'

বরাদ্দ কমানোর বিষয়ে তার ভাষ্য, 'বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতির কারণে আমরা স্বাভাবিকের তুলনায় কম বরাদ্দ চেয়েছিলাম। আমাদের যা প্রয়োজন তা পেয়েছি।'

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজেটে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত ৯৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে দেওয়া দেশীয় গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ পণ্য অনুসন্ধানের জন্য যথেষ্ট নয়।

জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার কথা উল্লেখ করে তারা বলছেন, দেশের গ্যাস ও কয়লার তোলার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পরিবর্তে বাজেটে মূলত জ্বালানি আমদানির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ১৩ শতাংশ কমে হয়েছে ৩০ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উৎপাদন বাড়ানোর পরিবর্তে সঞ্চালন ও বিতরণে সরকারের মনোযোগ দেওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তার মতে, 'এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে পর্যাপ্ত সঞ্চালন ব্যবস্থার অভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। অবকাঠামোর অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়ে যাওয়ার পরও উৎপাদনে যেতে না পারার ঘটনাগুলো খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছে।'

পরিবেশবান্ধব জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের প্রশংসাও করেছেন তিনি।

তবে এই অর্থনীতিবিদের মতে, পরিবেশবান্ধব জ্বালানির প্রসারে কাজ করা স্রেডাকে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেওয়া হতাশাজনক। 'এটি এমন এক সময়ে হলো যখন বায়ু শক্তি উৎপাদনকেন্দ্রগুলোর ওপর মনোযোগ দেওয়া উচিত।'

'সরকার বলছে তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে মনোযোগ দিচ্ছে। অথচ বাজেট বরাদ্দে তা দেখা গেল না। কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গবেষণার জন্য তহবিল পায়। এই তহবিল কিভাবে খরচ হয় সেগুলো খতিয়ে দেখা উচিত,' যোগ করেন তিনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ম তামিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা স্পষ্ট যে, বেশি দামের এলএনজি ও অন্যান্য জ্বালানি আমদানির তুলনায় দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে জ্বালানি বিভাগের জন্য বরাদ্দ খুবই কম।'

'ওভারক্যাপাসিটি থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাজেট বাড়ানোর প্রয়োজন নেই' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'সঞ্চালন ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় বিনিয়োগের এখনই সময়। সরকার প্রথমটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। দ্বিতীয়টি উপেক্ষিত হয়েছে।'

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দুই বিভাগে বরাদ্দের বিশাল ব্যবধান এটাই প্রমাণ করে যে সরকার জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা সুরক্ষিত না করেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে।'

Comments