রকি পর্বতের ‘লিসিয়েন্থাস’ যখন আদরের ‘নন্দিনী’

ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ ভবনের বারান্দা কিংবা এখাকার পুকুরপাড়ের পরীক্ষণ মাঠে গেলে তাকিয়ে দেখার আনন্দ লাভের পাশাপাশি ফুটন্ত ‘নন্দিনী’র স্পর্শসুখও লাভ করা সম্ভব।
নন্দিনী ফুল
‘নন্দিনী’ বাংলাদেশে ‘ইউস্টোমা’ নামেই বেশি পরিচিত। কেউ কেউ বলেন ‘লিসিয়েন্থাস’। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

মকররাজের যক্ষপুরীতে জীবনের কোনো প্রকাশ ছিল না। সেই অন্ধকার পাতালপুরীতে প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে আলোর বার্তা নিয়ে এসেছিল 'নন্দিনী'। কিন্তু লোভ, সংস্কার আর দাসত্বের মোহে বাঁধা পড়ে 'নন্দিনী'র সেই আনন্দস্পর্শ পাননি যক্ষপুরীর রাজা, সন্ন্যাসী, অধ্যাপক কিংবা মজুরদের কেউ।

তবে সৌন্দর্যের স্বাভাবিক চেতনা কিংবা ভালোবাসার ন্যুনতম বোধ থাকলে 'নন্দিনী'কে স্পর্শ করার বিষয়টি এখন খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ ভবনের বারান্দা কিংবা এখাকার পুকুরপাড়ের পরীক্ষণ মাঠে গেলে তাকিয়ে দেখার আনন্দ লাভের পাশাপাশি ফুটন্ত 'নন্দিনী'র স্পর্শসুখও লাভ করা সম্ভব।

এই 'নন্দিনী' সাহিত্যের পাতা থেকে উঠে আসা কোনো চরিত্র নয়। অনেকটা গোলাপের মতো দেখতে ভিনদেশি এক ফুল। দীর্ঘ গবেষণায় এক যুগেরও বেশি সময় আগে এই দেশের জল–হাওয়ায় ফুলটি ফোটাতে সক্ষম হয়েছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিন। তিনিই আদর করে এর নাম রেখেছেন 'নন্দিনী'।

নন্দিনী ফুল
দীর্ঘ গবেষণায় এক যুগেরও বেশি সময় আগে এই দেশের জল–হাওয়ায় ফুলটি ফোটাতে সক্ষম হয়েছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিন। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

'নন্দিনী' বাংলাদেশে 'ইউস্টোমা' নামেই বেশি পরিচিত। কেউ কেউ বলেন 'লিসিয়েন্থাস'। ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের রকি পর্বত এলাকায় ইউস্টোমার উৎপত্তি। মেক্সিকো, ক্যারিবীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর অংশের উষ্ণ অঞ্চলেও এই ফুল ফোটে। দেশের পুষ্প–অনুরাগীদের কাছে এর কদর থাকলেও দাম চড়া।

রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত, আলোচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ বলে ধরা হয় 'রক্তকরবী'কে (১৯২৬)। রূপকধর্মী এই নাটকের এর প্রধান চরিত্র নন্দিনী নামের এক নারী। নাটকটি রচনার পর থেকে প্রায় ১০০ বছর ধরে এর নিয়মিত মঞ্চায়ন হয়ে আসছে। কালক্রমে নন্দিনী হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী এক চরিত্র। সেখান থেকেই লিসিয়েন্থাসের নাম 'নন্দিনী' রাখা হয়েছে বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান অধ্যাপক জামাল উদ্দিন।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'রক্তকরবীর সমস্ত পালাটি নন্দিনী বলে একটি মানবীর ছবি। চারি দিকের পীড়নের ভিতর দিয়ে তার আত্মপ্রকাশ।'

টবের মাটিতে কিংবা বাগানের বেডে লাগানো গাছে অধ্যাপক জামালের ফোটানো 'নন্দিনী' দেখলে আশপাশের গাছে থাকা পরিচিত ফুলের তুলনায় এর ঋজু ভঙ্গি, নরম পাঁপড়ি ও পেলব রঙ আত্মপ্রকাশের সেই দৃপ্ত ভাবকেই মনে করিয়ে দিতে পারে।

নন্দিনী ফুল
অনেকটা গোলাপের মতো দেখতে ভিনদেশি এক ফুল ‘নন্দিনী’। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের কাছ থেকে জানা যায়, 'নন্দিনী' ফুলটি বুনো বৈশিষ্ট্যের। ঝড়, বৃষ্টি, প্রচণ্ড গরম বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ফুলের পাঁপড়ি অক্ষত থাকে। প্রতিটি ফুল শক্ত ডাঁটা বা বৃন্তের ওপর থাকে বলে কখনো বেঁকে যায় না কিংবা নুয়ে পড়ে না। একটানা ১৫ দিন পর্যন্ত ফুলটি অবিকল থাকে বলে দাম বেশি। ফুলদানির পানিতে সুক্রোজ (চিনি) মিশিয়ে ২৫ দিন পর্যন্ত তাজা রাখা যায়। ফুলের সঙ্গে চলে আসা কলিগুলো ঘরের স্বাভাবিক পরিবেশে ফুলদানিতেই কয়েক দিন পর সম্পূর্ণ ফোটে। সাধারণত জুন-জুলাইয়ে ফুলটি ফুটলেও সারা বছরই এর উৎপাদন সম্ভব। এর বৈজ্ঞানিক নাম Eustoma grandiflorum।

ফুলটি বাংলাদেশে এল যেভাবে

প্রায় দুই দশক ধরে এই বিদেশি ফুল নিয়ে কাজ করছেন অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দিন। তিনি জাপান থেকে এর বীজ ও মাটি নিয়ে এসেছিলেন। সেই মাটিতে ২০০৭ সালে প্রথম ফুটেছিল ফুলটি।

অধ্যাপক জামাল উদ্দিন জানান, একসময় উত্তর আমেরিকার রকি পর্বতমালা এলাকায় ফুলটি বুনো অবস্থাতেই ফুটত। গ্রীষ্মে বরফ গলার পর ফুল বেরিয়ে আসত। পরে জাপানিরা ফুলটি তাদের দেশে এনে গবেষণার ভেতর দিয়ে সেখানকার আবহাওয়ার উপযোগী করে তোলেন। তারাই এটিকে জাপানিজ লিসিয়েন্থাস, তরুকোগিকিও ও অন্য বৈজ্ঞানিক নামগুলো দেন।

'লিসিয়েন্থোসের সব ডেভেলপমেন্ট জাপানি বিজ্ঞানীরা করেছেন' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমি লাকিলি ওই গ্রুপটার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। সেই ১৯৯৭ সাল থেকে। জাপানে এখন এটি গোলাপ বা টিউলিপের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়।'

নন্দিনী ফুল
‘নন্দিনী’ একটি উন্নতমানের কাট-ফ্লাওয়ার। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

জামাল উদ্দিন মনে করেন, বাংলাদেশে 'নন্দিনী'র বাণিজ্যিক উৎপাদনের সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল। বাণিজ্যিক উৎপাদনে সাফল্য এলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ফুলের পাশাপাশি বীজ ও চারা রপ্তানির সুযোগ আছে।

তার ভাষ্য, বাংলাদেশে ফুল খুব জনপ্রিয় হচ্ছে। এটা একটা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশে কাট-ফ্লাওয়ারের বাণিজ্য বছরে ১২০০ কোটি টাকার বেশি। 'নন্দিনী' একটি উন্নতমানের কাট-ফ্লাওয়ার। গাছ থেকে যেসব ফুল তুলে ঘর কিংবা মঞ্চ সাজানোর কাজে বেশি দিন ব্যবহার করা যায়, তা কাট-ফ্লাওয়ার। কিন্তু শীতের মৌসুম বাদে সারা বছর সেভাবে কাট–ফ্লাওয়ার উৎপাদিত হয় না। এই ফুল সেই চাহিদা পূরণ করতে পারে।

বাংলাদেশে 'নন্দিনী'র বাণিজ্যিক চাষের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ

অধ্যাপক জামাল উদ্দিন আরও জানান, বিশেষ ব্যবস্থায় ও নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় 'নন্দিনী'র চারা উৎপাদন করতে হয়, যা মাঠপর্যায়ে সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে এর বীজ থেকে চারা উৎপাদন করার বিষয়টি খুব কঠিন। এখানকার স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বেড়ে ওঠা চারাগুলো কুঁকড়ে যায়। এ কারণে বীজ থেকে চারা উৎপাদনের জন্য গ্রোথ চেম্বার দরকার হয়। আমরা এটাকে প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরি বলি। সেখানে আলো ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এক্ষেত্রে চারা কোঁকড়ানোর আশঙ্কা কমে যায়।'

'নন্দিনী'র বীজ এত ছোট যে, অনেকক্ষেত্রে তা মাটিতে যথাযথভাবে পোঁতা সম্ভব হয় না বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক জামাল উদ্দিন। বলেন, 'এর বীজগুলো খুব ছোট ছোট। সরিষার ১৫ ভাগের এক ভাগ। এ জন্য আমরা একটি পিলেটিং মেশিন কিনতে যাচ্ছি; যাতে বীজের ওপর একটি কোটিং দিয়ে এগুলোকে খানিকটা বড় করে তোলা যায়। তাতে বীজ লাগাতে সুবিধা হবে।'

নন্দিনী ফুল
ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরপাড়ের পরীক্ষণ মাঠে ‘নন্দিনী’র বেড। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

সম্ভাবনা

বাংলাদেশে 'নন্দিনী' চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন এই গবেষক। তার ভাষ্য, গোলাপের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরদিনের। কিন্তু লাল-সাদা-গোলাপিসহ নানা রঙের গোলাপ পাওয়া গেলেও নীল রঙেরটা পাওয়া যায় না। অথচ নীলের প্রতি মানুষের আলাদা দুর্বলতা আছে। তাই জাপানসহ অনেক দেশে নীল রঙের লিসিয়েন্থাস খুব জনপ্রিয় হয়েছে।

উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের এই অধ্যাপক আরও বলেন, 'নন্দিনীর নীল বিভিন্ন শেডের হয়ে থাকে। কোনটা গাঢ়, কোনোটা হালকা। আবার সাদা পাঁপড়ির কিনারে হালকা নীল ছোপের নন্দিনীও আছে। এর বাইরে আছে গোলাপি নন্দিনী।'

তিনি বলছেন, এই ফুলের উৎপাদন খরচ অন্য ফুলের তুলনায় কম। কারণ এর একেকটি গাছে অন্তত পাঁচটি শাখা হয়। প্রতি শাখায় পাঁচটি করে ফুল ধরলেও অন্তত ২৫টি ফুল হয়। একেকটি ফুলে বীজ থাকে ৭০০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত। ফলে খুব সস্তায় চারা উৎপাদন সম্ভব। চারা তুলে মাঠে লাগানোর পর তা স্বাভাবিকভাবেই বাড়তে থাকে।

'আমাদের দেশে শীতের মৌসুম বাদে সারা বছর সেভাবে কাট–ফ্লাওয়ার উৎপাদিত হয় না। নন্দিনী সেই চাহিদা পূরণ করতে পারে। কারণ এটি সারাবছর হয়। সহজে নষ্ট হয় না বলে এই ফুল পরিবহন ও বাজারজাতকরণও সহজ।'

কয়েক বছর আগে একটি বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ২৫ ফুলচাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে 'নন্দিনী'র চারা সরবরাহ করা হয়েছিল জানিয়ে জামাল উদ্দিন বলেন, 'এতে চমৎকার ফল এসেছিল। কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে চারা উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে প্রচুর অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। এটার অভাব আছে।'

বাংলাদেশের বাজারে এখন চীন থেকে আমদানি করা একটি–দুটি ফুটন্ত ফুলসহ দু–তিনটি লিসিয়েন্থাসের কলির দাম পড়ে এক শ থেকে দেড় শ টাকা। তাই দেশে এই ফুলের বাণিজ্যিক উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারলে দাম অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

এ ছাড়া তার দেওয়া নাম 'নন্দিনী' প্রতিবেশী ভারত ও নেপালেও বেশ পরিচিতি পেয়েছে বলেও জানান তিনি।

Comments