বিশ্ব পানি দিবস

খাবার পানি যেখানে বিলাসিতা

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

রাজিয়া বেগমের (৫৬) বিয়ের সময় বয়স ছিল ১৬ বছর এবং তখন খাবার পানি নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না। খুলনার দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা গ্রামের অধিকাংশ নারীর মতো তিনিও আশপাশের পুকুর থেকেই পানি সংগ্রহ করতেন। তখন জীবন ছিল সহজ এবং পানির উৎস ছিল প্রচুর।

তবে চিংড়ি চাষের প্রসারে সবকিছু বদলে গেল। একসময় মিঠা পানিতে ভরপুর পুকুরগুলো ধীরে ধীরে লবণাক্ত হয়ে যায়। ২০০০ সালের গোঁড়ার দিকে রাজিয়া ও তার প্রতিবেশীরা একটি ক্রমবর্ধমান সংকটে পড়েন। ২০০২-০৩ সালের দিকে পানি সংগ্রহের বিষয়টি তাদের দৈনন্দিন জীবন যুদ্ধে পরিণত হয় এবং পরবর্তী বছরগুলোতে এর তীব্রতা বাড়তেই থাকে।

উপায়ান্তর না পেয়ে স্থানীয়রা আমতলা বানিশান্তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুকুরটি সংস্কার করলে রাজিয়া বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের ওই পুকুর থেকে পানি আনা শুরু করেন। তবে গত ৩-৪ বছর ধরে আর সেভাবে পানি আনতে পারেন না। কিডনির জটিলতা ও হাড় ক্ষয়ে যাওয়ায় পানির কলস নিয়ে হাঁটতে পারেন না। এ কারণে তারা পানি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

রাজিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের প্রতিদিন কমপক্ষে তিন কলস পানি লাগে। ১৫ লিটারের এক কলস পানির দাম ৩০ টাকা। বাড়িতে পৌঁছে দেয় বলে আরও ১০ টাকা দিতে হয়। এতে মাসে ২৫০০-২৭০০ টাকার বেশি খরচ হয়।'

মাত্র নয় হাজার টাকা আয়ে ১০ জনের পরিবারটিকে চলতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তার ওপর রাজিয়ার শ্বশুর প্রায় অচল, স্বামীও খুব অসুস্থ, কাজ করতে পারেন না। ইজিবাইক চালক ছেলে ও নিরাপত্তা প্রহরী জামাইয়ের ওপর নির্ভর করেই তাদের দিন চলে।

রাজিয়া বলেন, 'আমাদের পানির পেছনেই আয়ের ১৫-২০ শতাংশ ব্যয় হয়ে যায়। আর যদি পানিবাহিত রোগের পেছনে ওষুধের কথা ধরি, তাহলে খরচ আরও বেড়ে যাবে।'

'১০-১২ বছর আগে আট হাজার টাকা কিস্তিতে ১০০০ লিটারের একটি ট্যাংকি কিনেছিলাম। সেই পানি কয়েক দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যানকে অনেকবার বলেছি, কিন্তু কেউ আর ট্যাংকি দেয়নি, বলেন তিনি।

রাজিয়া বলেন, 'বড় ট্যাংকি কিংবা পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হলে এই সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।'

রাজিয়ার মেয়ে আসমা খাতুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাঝে মধ্যে কিনে আনা পানি খেয়েও আমার দুই মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বড় মেয়ের জন্য ডায়রিয়ার ওষুধ কিনতেই মাসে ৩০০-৪০০ টাকা খরচ হয়।'

রাজিয়ার বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে তাসলিমা বেগমের বাড়ি। তিনিও বাধ্য হয়ে পানি কিনে খাচ্ছেন। ২০ লিটার পানি হলে চারজনের পরিবারের একদিন চলে যায়।

তিনি বলেন, 'এলাকার একমাত্র পুকুর আমতলায় যেতে তিন কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়। আমি অসুস্থ, পানির কলস নিয়ে এই পথ পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নাই। আবার টাকা দিয়ে পানি কিনে খাব সেই সামর্থ্যও নাই। এখন বাধ্য হয়ে কিনে খাচ্ছি।'

এক মাসের পানি একসঙ্গে কিনে রাখলে ৫০-৬০ টাকা কমে পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে মাসে কমপক্ষে এক হাজার টাকার বেশি পানি কেনা লাগে বলে জানান তিনি।

তাসলিমা জানান, বছরের অন্তত পাঁচ-ছয় মাস পানি কিনে খেতে হয়। বর্ষার সময় বর্ষার পানি খান। পরিবারের আয়ের ২০-২৫ শতাংশ শুধু পানির পেছনে চলে যাচ্ছে।

৩৩ নম্বর পোল্ডারের পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় সব জায়গার সমস্যা একই।

পানি কেনার সামর্থ্য যাদের নেই অথবা পানি বিক্রির কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, সেসব অঞ্চলের নারীরা ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই পানি খুঁজতে বের হন।

তাদের কারও মাথায়, কারও পিঠে থাকে একাধিক বড় পানির কলস। নিরাপদ খাবার পানির সন্ধানে তাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়, যা কখনো কখনো শেষ হয় অন্য কোনো দূরবর্তী গ্রামে গিয়ে।

বছরের পর বছর ধরে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের অনেক নারীর জন্য এটাই বাস্তবতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও অনিয়মিত আবহাওয়ার কারণে লবণাক্ত পানি ক্রমশ ভেতরের দিকে প্রবেশ করছে, দূষিত হচ্ছে মাটির নিচের পানির উৎস।

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের এই বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রান্তিক নারীদের।

দাকোপ উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের তথ্যমতে, উপজেলায় এক হাজার ৮১৩টি টিউবওয়েল আছে, যার মধ্যে চালু আছে মাত্র ২৪৭টি। কিন্তু এর অধিকাংশের পানি পানের অনুপযোগী। পানি বিশুদ্ধ করার পিএসএফ আছে ৫৩২টি, কিন্তু এর মধ্যে চালু মাত্র ৫৬টি।

বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা শতাধিক রিভার্স অসমোসিস 'আরও' প্ল্যান্ট নষ্ট। শুধু এসডিএফেরই ৭২টা অকার্যকর। তাদের তৈরি মাত্র ৫-৬টি প্ল্যান্ট ভালো আছে।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দাকোপ উপজেলায় কোনো টিউবওয়েল ফাংশন করে না। যেকোনো একুয়িফায়ার গেলেও এটি কার্যকরী হয় না। তাই সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প নেওয়ার সময় এই উপজেলাকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে তা কার্যকরী করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি ভালো পুকুরগুলো সংরক্ষণ করে "আরও" এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানির সমস্যা কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব।'

ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জায়গায় পানি লবণাক্ত এবং খাবার অনুপযোগী। তাই এখানকার মানুষ খাবার পানির জন্য পুকুর ও বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভর করেন। অনেকে আবার বিভিন্ন সোর্স থেকে পরিশোধিত পানি কিনে তা পান করেন। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অনেক উপজেলা এবং ইউনিয়নে পানি বিক্রি করার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। দাকোপের শুধু ৩৩ নম্বর পোল্ডারেই এরকম আটটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে পানি শোধন করে বিক্রি করছে।

যদিও খাওয়ার পানির সমস্যার সমাধানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে, কিন্তু সমন্বয় ও আন্তরিকতার অভাবে সেই অর্থে কোনো সমাধান আসছে না। বরং লবণাক্ততার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে এবং খাবার পানির সংকর তীব্র হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার হচ্ছে নিরাপদ পানি পান করা, কিন্তু সেই অধিকার তারা পাচ্ছেন না। তাই এখন দরকার সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এই সমস্যা কমিয়ে আনা।

২০১৫ সাল থেকে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বেডস বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে এবং তা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পরিশোধন করে স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিক্রি করছে।

এই প্রতিষ্ঠানের তিনটি 'আরও' প্রতি ঘণ্টায় ১৫ হাজার লিটার পানি পরিশোধ করে করতে পারে।

বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বেডসের) নির্বাহী পরিচালক মো. মাকসুদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিদিন আমাদের এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লিটার পানি বিক্রি হয়। আমাদের টার্গেট তিনটি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের ১২ হাজার মানুষকে সেবা দেওয়া, বিশুদ্ধ পানি নামমাত্র মূল্যে সরবরাহ করা। আমরা প্রতি লিটার পানি ৫০ পয়সা দামে বিক্রি করছি। এর মাধ্যমে আমরা শুধু রক্ষণাবেক্ষণ খরচটা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করি।'

'আবার এই পানি অনেকে কিনে ভ্যানে করে বিভিন্ন গ্রামে বিক্রি করেন। যদিও তারা গ্রাহকের কাছ থেকে ২০ লিটার পানির জার বিশ টাকা থেকে দূরত্ব অনুসারে ৪০ টাকা পর্যন্ত নেন', বলেন তিনি।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল এর তথ্যমতে, এক লিটার পানিতে যদি ৬০০ মিলিগ্রাম স্যালাইনিটি বা ক্লোরাইড থাকে তাহলে তা পান করা যায়, কিন্তু উপকূলের এই মাত্রা তিন থেকে চার হাজার মিলিগ্রাম।

এই পরিমাণ লবণাক্ততা সাধারণ মানের "আরও"র মাধ্যমে শোধন করা সম্ভব হয় না। যদিও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নকশা বিভাগ নতুন ধরনের "আরও" উদ্ভাবনের কাজ করছে বলে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চের চেয়ারম্যান ও গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা ক্রমশ ভেতরের দিকে বিস্তৃত হচ্ছে। এতে উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য ও মানব স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে, বিশেষ করে নারীরা এর ভয়াবহ শিকার হচ্ছেন। দরিদ্র পরিবারগুলো বাধ্য হয়ে পানি কিনছে, ফলে তারা আরও বেশি প্রান্তিক হয়ে পড়ছে।'

খুলনার নারী নেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শামীমা সুলতানা শিলু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নারীদের ঘরের সব কাজ সামলাতে হয়। আবার পানি আনা-নেওয়ার কাজেও নারীরা বেশি ভূমিকা রাখেন। তাদের কয়েক কিলোমিটার পানি বয়ে আনতে হয়। ফলে তারা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। আবার পানি কেনার পেছনে নারীদের কাছে থাকা অর্থই বেশি ব্যয় করতে হয়। তাদের নিজেদের পিছনে ব্যয় করার মতো অর্থ আর থাকে না।'

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, উপকূলীয় তিন জেলায় গত পাঁচ বছরে তিন হাজার লিটার ধারণক্ষমতার এক লাখ ২৫ হাজার ৩২৪টি ট্যাংকি বিতরণ করা হয়েছে। যেন প্রান্তিক মানুষেরা বর্ষার সময় পানি সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে চার-পাঁচ মাস পান করতে পারেন।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের খুলনা অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক মো. জামানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশোধন করে পাইপের মাধ্যমে সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হলে সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যাবে। তাছাড়া বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে এ সমস্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। আমাদের মিঠা পানির আধারগুলো নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ লবণ পানির চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ করা। তাই এটাকে কার্যকর উপায়ে কমিয়ে আনা বা বন্ধ করা দরকার।'

'তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পানির প্রকল্পগুলো পরিচালনা করা ও যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা গেলে প্রকল্পগুলো আরও বেশি কার্যকরী হবে। সেই সঙ্গে বেসরকারি এনজিওগুলোর গৃহীত প্রকল্পগুলো যথাযথ জায়গায় নেওয়া যায় কিনা, তার জন্য ম্যাপিং করে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আর এই কাজে স্থানীয় সরকারকে সরাসরি কাজে লাগিয়ে পানির সমস্যার সমাধান করা সম্ভব, বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus in Rome to attend Pope Francis’ funeral

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus reached Rome yesterday to attend the funeral of Pope Francis.

7h ago