হরিণেরা খেলা করে…

পূর্ব সুন্দরবনের ডিমেরচর এলাকায় চিত্রা হরিণের পাল। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

স্বপ্নে ফাল্গুনের জোৎস্নার ভেতর পলাশের বনে হরিণের দলকে খেলা করতে দেখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রহেলিকাময় মানুষ জীবনানন্দ দাশ। বনে-বনে পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে এসব হরিণের চোখ থেকে হীরা আর মুক্তা ঝরতে দেখেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন, 'বাতাস ঝাড়িছে ডানা, হীরা ঝরে হরিণের চোখে–/হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলোকে।'

এদিকে ১৯৩১ সালে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত 'পরিচয়' পত্রিকায় প্রকাশিত জীবনানন্দের 'ক্যাম্পে' শিরোনামের কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ হলো হরিণ শিকার। কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর অশ্লীলতার অভিযোগে সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। একইসঙ্গে রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবিতাপর্বে আধুনিকতার উন্মেষকারী ও যুগ বদলকারী কবিতা হিসেবেও বিবেচনা করা হয় জীবনানন্দের এই কবিতাটিকে।

সেই 'ক্যাম্পে' কবিতায় জীবনানন্দকে বলতে শোনা যায়, '…যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা ম'রে যায়/হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এলো যাহাদের ডিশে/তাহারাও তোমার মতন;/ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদেরো হৃদয়।'

কবিতায় জীবনানন্দ ঠিক কোন প্রজাতির হরিণের কথা বলেছেন তা ঠিক জানা যায় না। কারণ এই উপমহাদেশে অন্তত ছয় প্রজাতির হরিণের দেখা মেলে। তবে এগুলোর ভেতর সবচেয়ে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন হিসেবে পরিচিত ছবির এই চিত্রা হরিণ।

পূর্ব সুন্দরবনের কটকা অফিসপাড় এলাকায় হরিণের দল। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

চিত্রা হরিণ বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু চোরাশিকারিদের হাতে দিনের পর দিন চিত্রা হরিণ নিধনের বিষয়টি বলতে গেলে 'ওপেন সিক্রেট'।

২০২৩ সালের শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে চিত্রা হরিণের সংখ্যা ১ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি। ২০০৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজারের মতো।

কিন্তু শিকারিদের অপতৎপরতার কারণে হরিণসহ আরও কিছু বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বাড়ার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিমত বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের।

বন বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, সুন্দরবন–সংলগ্ন এলাকাগুলোয় শিকারিরা অনেক শক্তিশালী। এদের বড় নেটওয়ার্ক আছে। শুধু কয়রা উপজেলাতেই রয়েছে ৩০টির মতো শিকারি দল। তাদের ধরতে সুন্দরবন–সংলগ্ন লোকজন খুব একটা সহযোগিতা করে না। মানুষ সাক্ষ্য দিতেও ভয় পায়। তারা এ সুযোগ নিয়ে আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে।

বন বিভাগের তথ্য অনুসারে, গত এক বছরে সুন্দরবন থেকে অন্তত ৪০ জন শিকারিকে হরিণের মাংস–চামড়াসহ আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫১২ কেজি হরিণের মাংস, একটি জবাই করা হরিণ, পাঁচটি চামড়া ও মাথা উদ্ধার করা হয়েছে। তবে বনরক্ষীরা যে পরিমাণ হরিণের মাংস উদ্ধার ও শিকারিদের আটক করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি হরিণ শিকারিদের হাতে মারা গেছে বলে ভাষ্য স্থানীয়দের।

সংঘবদ্ধ শিকারিরা মাছ ধরার পাস নিয়ে গহিন বনে ঢুকে গাছের ফাঁকে ফাঁকে নাইলনের দড়ির ফাঁদ পেতে রাখে। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো ফাঁদে আটকে যায়। ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে হরিণের মাংস অগ্রিম অর্ডারও নেয় শিকারিরা। আর তাদের আশ্রয় দেয় প্রভাশালীরা। এ কাজে যোগসাজশ আছে বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরও। 

সম্প্রতি এমন একটি ঘটনার তদন্তে নেমে বন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চোরা শিকারিদের যোগসাজশের প্রমাণ পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এতে দেখা যায়, খুলনার কয়রায় জব্দ করা ১২০ কেজি হরিণের মাংসের মধ্যে ৯৫ কেজিই গায়েব করেছিলেন বনকর্মীরা। এ জন্য বন বিভাগের চার কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আটজনের বিরুদ্ধে গত ফেব্রুয়ারি মাসে কয়রা আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পিবিআই।

এছাড়া বিভিন্ন অভিযানে আটক হরিণশিকারিদের তথ্য থেকে জানা যায়, বনের পাশে যাদের বাড়ি, তারাই বেশি হরিণ শিকারের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা এবং বাগেরহাটের মোংলা ও শরণখোলা উপজেলার মানুষ বেশি হরিণ শিকার করেন।

প্রাকৃতিক পরিসরে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় চিত্রা হরিণের দেখা মেলে। 

সম্প্রতি পূর্ব সুন্দরবনের ডিমেরচর এলাকা থেকে হরিণের পালের এই ছবিটি তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী হাবিবুর রহমান।

Comments

The Daily Star  | English

Not satisfied at all, Fakhrul says after meeting Yunus

"The chief adviser said he wants to hold the election between December and June"

2h ago