ময়লার ভাগাড় নাকি বুড়িগঙ্গার তীর
জিঞ্জিরা ফেরিঘাট থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীতীরের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা যাবে, গৃহস্থালিসহ নানা ধরনের আবর্জনা সেখানেই ফেলা হচ্ছে। এটাই যেন ঢাকার 'জীবনরেখা' বুড়িগঙ্গার চিরাচরিত চিত্র!
বুড়িগঙ্গার পানির রঙ প্রায় কালো। আবার কিছু কিছু স্থানে এর রঙ গোলাপিও। শিল্প-কারখানার বর্জ্যের কারণেই মূলত বুড়িগঙ্গা পানির রঙ বদলে গেছে।
জিঞ্জিরার বাসিন্দা নাসির হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিল্প ও অন্যান্য বর্জ্যের কারণে নদী থেকে প্রবল দুর্গন্ধ আসে। ফলে স্থানীয়দের শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হয়। কিন্তু, এখানে বসবাস করলে তো তা সহ্য করতেই হবে।'
'শুষ্ক মৌসুমে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। কারণ তখন নদীর পানি কুচকুচে কালো হয়ে যায়', যোগ করেন তিনি।
সম্প্রতি জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনের (এনআরসিসি) চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে বুড়িগঙ্গা পরিদর্শনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
লাসমানগঞ্জের বাসিন্দা আনোয়ার আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীবাঁধের চারপাশে বসবাসকারী লোকজন এতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে, যাতে নদীতীরে আরও জায়গা তৈরি হয়। এরপর তারা নৌকা তৈরি বা অস্থায়ী দোকান স্থাপনসহ বিভিন্ন কাজে জায়গাটি ব্যবহার শুরু করে।'
'অনেক জায়গায় এত বেশি পরিমাণে আবর্জনা ফেলা হয়েছে যে, বেড়িবাঁধের সীমানা নির্ধারণকারী কংক্রিট ব্লকগুলোও ঢেকে গেছে।'
সরেজমিনে লাসমানগঞ্জে বুড়িগঙ্গার তীরে একটি অস্থায়ী বাঁশের কাঠামো দেখা যায়। সেটা দেখেই বোঝা গেল যে, আবর্জনা ফেলে স্তূপ করে তার ওপর সেটা তৈরি করা হয়েছিল।
জিঞ্জিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাকুর হোসেন বলেন, 'নদী থেকে এসব বর্জ্য অপসারণের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা নদীতে আবর্জনা ফেলার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটি প্রচারাভিযানও চালাচ্ছি।'
তবে, স্থানীয়দের অভিযোগ, দখলদাররা বছরের পর বছর ধরে নদীর তীর দখল করে রেখেছে এবং কর্তৃপক্ষও এক্ষেত্রে নীরব।
এমন একটি দখলকৃত স্থানে কিছু নৌকাচালককে নৌকা মেরামত করতে দেখা যায়। জিজ্ঞাসা করলে তারা জানান, জায়গাটি যে নদীর, সে বিষয়ে তারা অবগত নন।
স্থানীয়রা জানান, কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা ফেরিঘাটের পাশে নদীর একটি বড় অংশ এ প্রক্রিয়ায় ভরাট হয়ে গেছে এবং তার ওপর বছরখানেক আগে একটি সরু রাস্তাও নির্মাণ করা হয়েছে।
এ ছাড়াও, নদীতীরেই রয়েছে কয়েক ডজন ডাইং কারখানা, যেগুলো নদী দূষিত করার অন্যতম কারণ।
হাইকোর্ট, পরিবেশ অধিদপ্তর ও এনআরসিসি বিভিন্ন সময়ে এসব কারখানাকে তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে।
নদীজুড়ে কালো জলের যে আধিপত্য, এর পেছনে ভূগর্ভস্থ পাইপগুলোও দায়ী, যেসব পাইপের মাধ্যমে বর্জ্যগুলো নির্গত হয়।
সম্প্রতি এনআরসিসির এক জরিপে কেরানীগঞ্জে নদী দূষণের ১৬৫টি উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৬৫টি ড্রেন ও পাইপলাইন, যার মাধ্যমে কঠিন, গৃহস্থালি ও রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্কাশন করা হয়।
সমীক্ষায় দূষণের একটি প্রধান কারণ হিসেবে রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্কাশনকারী শিল্পগুলোকে দায়ী করা হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি দেখে এনআরসিসি চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর কেরানীগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে বলেছেন, যারা নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে।
তিনি আরও বলেন, 'নদী দূষণের দায়ে কেরানীগঞ্জের ৪৯টি ডায়িং কারখানা সিল করে দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।'
'তবে, সম্প্রতি সিল করা ১০টি কারখানা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সেগুলোর মধ্যে অন্তত ৪টি এখনো চালু রয়েছে। যেসব কারখানা বন্ধ পাওয়া গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আসছেন শুনে সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা পালিয়ে গেছেন', যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জের ইউএনও মোহাম্মদ মেহেদী হাসান ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমরা খুব শিগগিরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করব।'
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক (সদরঘাট) মো. আলমগীর কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বুড়িগঙ্গাকে দূষণ ও দখলের হাত থেকে রক্ষা করতে আমরা সজাগ রয়েছি। আমরা আমাদের কাজ অব্যাহত রাখব।'
Comments