পৌরসভার ‘প্রাণবিনাশী’ উন্নয়নের বলি ১১৮ বছরের শ্যামাবাবুর খাল

টাঙ্গাইলের স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবিদদের অভিমত, এই প্রাণবিনাশী উদ্যোগের কারণে শতবর্ষী খালটির অস্তিত্বই শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শ্যামাবাবুর খাল
বিশ্বাস বেতকা এলাকায় ১১৮ বছর বয়সী শ্যামাবাবুর খালের অংশটুকুকেও নালায় পরিণত করার কাজ করছে টাঙ্গাইল পৌরসভা। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

৩ দশক আগে ১১৮ বছর বয়সী শ্যামাবাবুর খালের অর্ধেকেরও বেশি অংশ নালায় (ড্রেন) পরিণত করেছিল টাঙ্গাইল পৌরসভা। এর ভেতর দিয়ে খালটির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যহত হওয়ার পাশাপাশি তা হয়ে ওঠে দখল-দূষণের কেন্দ্র।

এবার খালের বিশ্বাস বেতকা এলাকায় অবশিষ্ট অংশটুকুও নালায় পরিণত করার কাজ শুরু করেছে পৌরসভা।

টাঙ্গাইলের স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবিদদের অভিমত,  এই প্রাণবিনাশী উদ্যোগের কারণে শতবর্ষী খালটির অস্তিত্বই শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

টাঙ্গাইল পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় বিন্দুবাসিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্যামাচরণ গুপ্ত পৌর পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান থাকার সময় শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ও স্থানীয় নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৯০৫ সালে শহরের প্যাড়াডাইসপাড়ায় লৌহজং নদী থেকে বিশ্বাস বেতকা বুরাই বিল পর্যন্ত খালটি খনন করেন।

সেই থেকে স্থানীয়দের কাছে খালটি শ্যামাবাবুর খাল হিসেবে পরিচিত ছিল।

দেশ স্বাধীনের পরও ৩৫ থেকে ৪০ ফুট চওড়া খালটি দিয়ে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌকা চলতো। ১৩৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত পৌর শহরটির পয়ঃনিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম ছিল এই খালটি।

টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক সচিব ও টাঙ্গাইল সংগ্রহশালার সভাপতি ইসমাইল হোসেন সেলিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তখন এ অঞ্চলে সড়ক ব্যবস্থা তেমন ছিল না। নৌপথেই ছিল যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। শ্যামাবাবুর খাল দিয়ে নৌপথে যাতায়াতের পাশাপাশি হাট-বাজারে পাটসহ নানান পণ্য আনা-নেওয়া করা হতো।'

শ্যামাবাবুর খাল
নালায় পরিণত হচ্ছে ১১৮ বছর বয়সী শ্যামাবাবুর খাল। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

তিনি জানান, ১৯৯০ এর দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কম্পার্টমেন্টালাইজেশন পাইলট প্রজেক্টের আওতায় সদর উপজেলার যুগনীতে লৌহজং নদীর ওপর স্লুইস গেট তৈরি করা হয়। এতে উজানে ধলেশ্বরীর উৎসমুখে বালি জমে লৌহজং নদীতে পানি প্রবাহ কমে যায়। এরপর থেকে নদীটি ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকে।

এর প্রভাবে পড়ে লৌহজং থেকে বের হওয়া অন্য খালগুলোর ওপরও।

একই প্রকল্পের আওতায় শহরের কেন্দ্রে শ্যামাবাবুর খালের উৎসমুখ প্যাড়াডাইসপাড়া থেকে গোডাউন সেতু পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করা হলে খালটির মৃত্যু হয়।

'এর কয়েক বছর পর ওই ড্রেনের ওপর বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দেয় পৌর কর্তৃপক্ষ। ফলে ড্রেনটি পরিষ্কারের পথও বন্ধ হয়ে যায়,' যোগ করেন তিনি।

পৌরসভা সূত্রে আরও জানা গেছে, এবার পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় খালের বাকি অংশ তথা বিশ্বাস বেতকা এলাকায় ড্রেন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।

স্থানীয়রা ডেইলি স্টারকে জানান, খালটির বেতকা অংশটুকুও ইতোমধ্যে দখল আর দূষণে ভরাট হয়ে গিয়েছিল। খালের যে অংশ পৌরসভার সেন্ট্রাল ড্রেনে পরিণত হয়েছে সেসব জায়গায় সু্য়ারেজ লাইন সরাসরি সংযুক্ত করে দেওয়ায় নোংরা পানি এসে খালের বাকি অংশকে দূষিত করে।

তাদের মতে, ফলে এলাকাটি মশা আর রোগ জীবাণুর প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ায় ড্রেন করে তা ঢেকে দেওয়া হচ্ছে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খালটি হারিয়ে যাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা বেড়েছে। পাশাপাশি খালের দখলদারিত্ব মেনে নেওয়া হচ্ছে।

শ্যামাবাবুর খাল
শ্যামাবাবুর খালের নালায় পরিণত হওয়া অংশে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে টাঙ্গাইল পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

টাঙ্গাইল জেলা নদী-খাল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব রতন আহম্মেদ সিদ্দিকী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা চরমভাবে হতাশ হয়েছি। আগে খালের যে অংশে ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে সেটুকুকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এটি শহরবাসীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খালটি পুনরুজ্জীবিত করার যে আশা ছিল বেতকা অংশে ড্রেন তৈরির মাধ্যমে তাও শেষ হয়ে গেল।'

তিনি আরও বলেন, 'শহরের মধ্য দিয়ে খনন করা শ্যামাবাবুর খালটি ছিল শহরের পানি নিষ্কাশন প্রধান মাধ্যম। ড্রেনে পরিণত করার পর ময়লা জমে তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন পানি যাওয়া পথ নেই। মাঝারি বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হয়।'

তার আশঙ্কা, শহরটিতে মানুষ বাড়ার সঙ্গে যে হারে বহুতল ভবন আর অপরিকল্পিত অবকাঠামো করা হচ্ছে তাতে অচিরেই পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়বে। মাঝারি বৃষ্টিতেই শহর ডুববে। ড্রেনে আটকে থাকা বর্জ্যে পরিবেশ মারাত্মক দূষিত হবে। একসময় শহরটি বাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।'

তিনি মনে করেন, ড্রেন নির্মাণ কোনো সমাধান নয়। বরং যেকোনো মূল্যে খালগুলো উদ্ধার করতে হবে। খালটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে যদি এর উৎস লৌহজং নদী খনন করে পানি আনতে হয় তবে তাই করতে হবে। এর বিকল্পও নেই।

গীতিকার মাসুম ফেরদৌস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা একসময় শ্যামাবাবুর খালে গোসল করেছি। দেখেছি খালটি কেমন ছিল। ড্রেন হওয়ার পর খালের জায়গা দখল হয়ে গেছে। ড্রেনগুলোও ঠিকভাবে করা হয়নি। পানি নিষ্কাশন হয় না।'

টাঙ্গাইল পৌরসভার প্যানেল মেয়র হাফিজুর রহমান স্বপন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জনস্বার্থেই খালটির বিশ্বাস বেতকা অংশে মাস্টার ড্রেন করা হচ্ছে। এরপর ২ পাশের জমি উদ্ধার করে পায়ে হাঁটা পথ করে দেওয়া হবে।'

শুধু শ্যামাবাবুর খালই নয় বরং টাঙ্গাইল শহরের অধিকাংশ খালই অস্তিত্ব হারিয়েছে উল্লেখ করে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন—প্রভাবশালীরা খালের জমি দখল করে নিয়েছেন। কেউ সেই জমিতে বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনা তৈরি করেছেন। আবার কোনো খাল ভরাট করে রাস্তা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টাঙ্গাইল শহরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ২৭ খালের অধিকাংশেরই অস্তিত্ব নেই। মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা হয়েছে। এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে হারিয়ে যাওয়া আর হারিয়ে যেতে বসা খালগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

$800m repayment to Russia in limbo

About $809 million has piled up in a Bangladesh Bank escrow account to repay loans and interest for the Russia-funded Rooppur Nuclear Power Plant.

11h ago