এইখানে প্রবালের শব পড়ে আছে

সাগরের রহস্যতলে জলদেবী বারুণীকে মণিদ্বীপ জ্বালতে দেখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। সেখানে প্রবাল-পালঙ্কের পাশে থাকা মৎসকুমারী কীভাবে নাবিককে ‘পিছুডাকা স্বর’ আর ‘নোঙর’ ভুলিয়ে দেয়, কবিতায় সে চিত্রও এঁকেছিলেন তিনি।
বঙ্গোপসাগরের তীরে পড়ে থাকা মৃত প্রবাল পলিপ। ছবি: শরীফ সারওয়ার

সাগরের রহস্যতলে জলদেবী বারুণীকে মণিদ্বীপ জ্বালতে দেখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। সেখানে প্রবাল-পালঙ্কের পাশে থাকা মৎসকুমারী কীভাবে নাবিককে 'পিছুডাকা স্বর' আর 'নোঙর' ভুলিয়ে দেয়, কবিতায় সে চিত্রও এঁকেছিলেন তিনি। দিকভ্রান্ত সে নাবিকের অবস্থা বর্ণনায় তিনি লিখেছিলেন, 'কোন্‌ দুর কুহকের কূল/লক্ষ্য করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল/কে বা তাহা জানে!'

দুনিয়ার তিনভাগ জুড়ে থাকা দিকচিহ্নহীন সমুদ্রের অথই পাথার প্রাণেরও বিপুল ভাণ্ডার। বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, সারা পৃথিবীতে যত প্রাণী আর উদ্ভিদ আছে, পরিমাণের দিক থেকে তার প্রায় ছয় ভাগের পাঁচ ভাগই আছে সমুদ্রে। কারণ পানির পরিবেশ প্রাণের পক্ষে যেমন স্বাচ্ছন্দ্যের, তেমনটি আর কোথাও নয়।

তবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পানির তাপমাত্রা এবং সমুদ্রের লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে অনেক সামুদ্রিক প্রাণীর অস্তিত্ব। এর ভেতর অতিমাত্রায় ঝুঁকির মধ্যে আছে অ্যান্থজোয়া শ্রেণিভুক্ত সামুদ্রিক প্রাণী প্রবাল।

প্রবাল এক ধরনের অমেরুদণ্ডী সামুদ্রিক প্রাণী। বহিরাবরণ শক্ত হওয়ার কারণে অনেক সময় একে ভুল করে পাথর ভাবা হয়। পলিপ নামের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর সমন্বয়ে তৈরি হয় একেকটি প্রবাল।

ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাল। ছবি: শরীফ সারওয়ার

সাধারণত গভীর সমুদ্র যেখানে আলো প্রায় পৌঁছায় না বললেই চলে, সেখানে রঙ-বেরঙের বিভিন্ন প্রজাতির প্রবালের দেখা মেলে। এদের দেহ নিঃসৃত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (CaCO3) জমাট বেঁধে কঠিন বহিঃকঙ্কাল তৈরি করে। কিন্তু নিজের শরীরে কোনো কঙ্কাল নেই প্রবালের। মূলত বাইরের দিকে সৃষ্ট এই কঙ্কালের আবরণে বাস করে প্রবাল।

প্রবাল কেবল দেখতেই সুন্দর নয়; সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে এর অবদানও অসামান্য। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সমুদ্রের ২৫ শতাংশ প্রজাতি প্রবালপ্রাচীরের মধ্যে বা এর আশপাশে বাস করে। ফলে সমুদ্রের নিচে পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় আবাসস্থলের মধ্যে একটি ধরা হয় এসব প্রবালপ্রাচীরকে। সামুদ্রিক জীব ছাড়াও প্রবালপ্রাচীর লাখো মানুষের খাদ্য এবং জীবিকার উৎস। এছাড়া সমুদ্রের দুর্যোগপূর্ণ ঢেউ এবং বন্যার ক্ষতি থেকে উপকূলকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত রক্ষা করে এই প্রবালপ্রাচীর।

রঙ হারাচ্ছে প্রবালপ্রাচীর

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান গবেষক ওভ হোয়েগ-গুল্ডবার্গ কোরাল ব্লিচিং বা সামুদ্রিক শৈবালের রং হারানোর মতো একটি দুর্যোগের কথা জানান। গত বছরের ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, 'ব্লিচিং পাউডার দিয়ে রঙিন কাপড় বেশি ধুলে কাপড় তার উজ্জ্বলতা হারায়। একইভাবে রঙিন প্রবালপ্রাচীরের রং সাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনা জীববিজ্ঞানীদের চোখে পড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রবালপ্রাচীরের ভবিষ্যৎ ভালো নয়। ২০২৩ সালের বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সামুদ্রিক প্রবালের অবস্থা বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে রঙিন প্রবালপ্রাচীর সাদা হয়ে যাচ্ছে। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফসহ বিভিন্ন প্রবালপ্রাচীর মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।'

৪০ বছর ধরে বিজ্ঞানী-গবেষকরা এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রবালপ্রাচীরের মধ্যে ঝুঁকির এ বিষয়টি লক্ষ করা যায় গত শতকের আশির দশক থেকে। কিন্তু রোগ, দূষণ, অতিরিক্ত সূর্যালোক নাকি পানির লবণাক্ততার পরিবর্তনে প্রবালপ্রাচীর তার রঙিন ভাব হারায়, তা নিয়ে তখন গবেষণা করা হয়নি। বিজ্ঞানী হোয়েগ-গুল্ডবার্গ প্রবাল পরীক্ষা করে প্রথম বিশ্বের সামনে কোরাল ব্লিচিংয়ের ধারণা প্রকাশ করেন।

অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের প্রবালপ্রাচীর। ছবি: রয়টার্স

এই ধারণা অনুসারে প্রবাল একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার সীমার মধ্যে সক্রিয় থাকে। সেই তাপমাত্রা বেড়ে গেলে প্রবালের রং ও পুষ্টির উৎস ক্ষুদ্র শেওলাগুলো ভেতর থেকে বের হয়ে যায়। আর তাই তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে প্রবালপ্রাচীর একপর্যায়ে সাদা হয়ে যায়।

হোয়েগ-গুল্ডবার্গের অভিমত, ২০২২ সালে পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রবালপ্রাচীর অষ্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ ষষ্ঠবারের মতো ব্লিচিংয়ের শিকার হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আগামী কয়েক দশকে এসব প্রবালপ্রাচীর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করেন তিনি।

আবার ২০২১ জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রবালপ্রাচীর পর্যবেক্ষণকারী গ্লোবাল কোরাল রিফ মনিটরিং নেটওয়ার্ক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ১৪ শতাংশ প্রবালপ্রাচীর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত এই প্রবালপ্রাচীরের আয়তন ১১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্রের উষ্ণতা যেভাবে বাড়ছে, তা চলতে থাকলে বিলীন হয়ে যেতে পারে আরও অনেক বিস্তৃত এলাকা।

এই গবেষণার অংশ হিসেবে গ্লোবাল কোরাল রিফ মনিটরিং নেটওয়ার্কের বিজ্ঞানীরা ৭৩টি দেশের ১২ হাজার এলাকার তথ্য ৪০ বছর ধরে বিশ্লেষণ করেন। ওই বিশ্লেষণ অনুসারে, প্রবালপ্রাচীরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে দক্ষিণ এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, পূর্ব এশিয়া, পশ্চিমাঞ্চলীয় ভারত মহাসাগর ও পারস্য উপসাগরীয় এলাকায়।

অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের প্রবালপ্রাচীর। ছবি: রয়টার্স

আর প্রবালপ্রাচীর বিলুপ্তির জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত মাছ ধরা, সাময়িক উপকূলীয় উন্নয়ন ও পানির গুণাগুণ কমে যাওয়ার মতো আরও কিছু কারণকে দায়ী বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

২০৪৫ সালের মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ প্রবালশূন্য হওয়ার আশঙ্কা

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনেও দিন দিন প্রবালের পরিমাণ কমে আসছে। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হতে পারে।

ওই নিবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. কাউসার আহাম্মদ, ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক মো. ইউসুফ গাজী ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী তাহরিমা জান্নাত স্যাটেলাইট থেকে তোলা ১৯৮০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সেন্টমার্টিনের ছবি বিশ্লেষণ করে দেখান, ৩৮ বছরে দ্বীপটিতে প্রবাল আচ্ছাদন ১ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩৯ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে ৪ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে নেমেছে ৩ বর্গকিলোমিটারে।

ওই গবেষণায় গবেষণায় সেন্ট মার্টিনের পরিবেশদূষণ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির জন্য কয়েকটি মানবসৃষ্ট কারণও চিহ্নিত করেন গবেষকরা। যার মধ্যে অন্যতম অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, আবাসিক হোটেলগুলোর দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যটকদের ব্যবহৃত সামগ্রী সমুদ্রের পানিতে নিক্ষেপ, পাথর উত্তোলন, প্রবাল উত্তোলন ও উপকূলীয় এলাকায় মাছ ধরার জালের যত্রতত্র ব্যবহার।

প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনে একটি প্রবাল কলোনি। ছবি: মোহাম্মদ আরজু/সেভ আওয়ার সি

গবেষকেরা আরও বলেন, সেন্ট মার্টিনে নতুন জন্মানো প্রবালগুলো জেলেদের জালের টানে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জেলেরা দ্বীপের চারপাশে তীর থেকে প্রায় ৫০০ থেকে ১ হাজার মিটার উপকূলবর্তী এলাকায় জাল ফেলে মাছ ধরেন, যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রবালের জন্ম হয়।

এদিকে বিশ্বজুড়ে কোরাল ব্লিচিংয়ের কারণে বিলুপ্তির হুমকি তৈরি হওয়ায় প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন প্রবালকে তাদের লাল তালিকায় শ্রেণিবন্ধ করে এটিকে সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছে।

শহর কলকাতায় দেখা স্বাতীতারা নামে কোনো এক নারীকে উদ্দেশ্য করে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, '…সকল কঠিন সমুদ্রে প্রবাল/লুটে তোমার চোখের বিষাদ ভর্ৎসনা…প্রেম নিভিয়ে দিলাম প্রিয়।'

এখন পৃথিবীর সকল সমুদ্রের প্রবাল যদি এভাবে নিঃশেষিত হতে থাকে, তাহলে এ যুগের প্রেমিকরা প্রেমিকার চোখের বিষাদ, প্রেম নেভাবেন কী দিয়ে?

আবার আশ্রয় ও খাদ্যের জন্য এসব প্রবালপ্রাচীরের ওপর নির্ভরশীল হাজারো প্রজাতির মাছ, কাঁকড়াসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীরও বা কী হবে? কারণ, প্রবালের মৃত্যু মানে তো এদেরও মৃত্যু।  

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

6h ago