দখল-দূষণে মৃতপ্রায় ময়ূর নদে এবার বাঁধ দিয়ে সেতু নির্মাণ

প্রতিনিয়ত দখলে সংকুচিত হচ্ছে ময়ূর নদের আয়তন। দূষণে পানির চেহারা কুচকুচে কালো। জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার মতো দ্রবীভূত অক্সিজেনও (ডিও) নেই। একসময়ের খরস্রোতা নদটি এখন এক মরা খাল। বাঁধ দেওয়ার ফলে এটি আরও অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা পরিবেশবাদীদের।
ময়ূর নদে বাঁধ দিয়ে সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। ছবি: স্টার

খুলনা মহানগরীর গল্লামারী এলাকায় ময়ূর নদের ওপর পাশাপাশি দুটি সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। গত বছরের ১২ অক্টোবর সেতু নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়। এখন নদের পশ্চিম পাশে পিলার বসানোর কাজ চলছে। 

ইতোমধ্যে ময়ূর নদে প্রায় ৩০ ফুট চওড়া বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে নদের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে কাজের দীর্ঘসূত্রিতা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তাই এই সেতুর নির্মাণকাজ কখন শেষ হবে, তা বলা যায় না। সে পর্যন্ত যদি এই বাদ অপসারণ না করা হয় তাহলে নদটি অস্তিত্ব হারাবে।

খুলনা নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একমাত্র মিঠা পানির উৎস ময়ূর নদ। দখল-দূষণে এই নদের অবস্থা এখন মৃতপ্রায়। নদের পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে দ্বিতীয়বারের মতো প্রায় ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা খরচ করে খননকাজ করছে সিটি করপোরেশন। এরইমধ্যে সড়ক ও জনপদ বিভাগ নদের ওপর দুটি সেতু নির্মাণ করছে। সেতু নির্মাণের সুবিধার্থে নদে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। 

সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নদের ওপর থাকা দুটি সেতু ভেঙে সেখানে হাতিরঝিলের আদলে দৃষ্টিনন্দন দুটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।

সরেজমিনে গল্লামারী সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেতু নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম আনা-নেওয়া ও কাজ করার সুবিধার্থে নির্মাণাধীন সেতু বরাবর আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। প্রায় ১০০ ফুট দীর্ঘ বাঁধের পশ্চিম পাশে দুই-তিন ফুট প্রস্থের ছোট একটি পাইপ বসানো হয়েছে। সেই পাইপ দিয়ে সামান্য পানি আসা-যাওয়া করছে।

খুলনা নগরীতে মিষ্টি জলের একমাত্র আঁধার ময়ূর নদ। এটি ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ। নদটি খুলনা নগরীর পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। আগে রূপসা নদীর সঙ্গে ময়ূর নদের সরাসরি সংযোগ ছিল। এখন জলকপাটের (স্লুইসগেট) মাধ্যমে জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রিত। নিয়মিত তদারকির অভাবে স্লুইসগেট বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। ফলে নদের পানিপ্রবাহও বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রতিনিয়ত দখলে সংকুচিত হচ্ছে ময়ূর নদের আয়তন। দূষণে পানির চেহারা কুচকুচে কালো। জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার মতো দ্রবীভূত অক্সিজেনও (ডিও) নেই। একসময়ের খরস্রোতা নদটি এখন এক মরা খাল। বাঁধ দেওয়ার ফলে এটি আরও অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা পরিবেশবাদীদের।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোথাও বেড়া দিয়ে, কোথাও মাটির বাঁধ দিয়ে নদের জায়গা দখল করা হয়েছে। আবার নদের পাড়ের অনেক মানুষ একটু একটু করে ভরাট করে জায়গা বাড়িয়ে নিচ্ছে। এরইমধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নদে বাঁধ দেওয়া হলো।'

তিনি বলেন, 'নদের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ চলমান রেখেই সেতুর নির্মাণকাজ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই বাঁধ দেওয়া যাবে না। যেখানে সিটি করপোরেশন এই নদটি দ্বিতীয়বারের মতো প্রায় ৮ কোটি টাকা খরচ করে খনন করছে, সেখানে নদে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করা হলো এক ধরনের দ্বৈত আচরণ।' 

'আমরা দেখেছি, নির্মাণকাজের মেয়াদ শেষ হলেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্রুত চলে যায়। তারা সেতুর নিচের মাটি আর সরিয়ে দেয় না। এতে নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডে দেখার কথা থাকলেও কোনো কর্মকর্তা এক দিনের জন্যও এখানে আসেননি', বলেন এই পরিবেশবাদী। 

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার কাছারি বাড়ি এলাকার বাসিন্দা নিমাই চন্দ্র রায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। খুলনা শহরে এসেছিলেন ব্যক্তিগত কাজে। অনেকক্ষণ ময়ূর নদের আশপাশে ঘুরে ঘুরে সেতুর নির্মাণকাজ দেখছিলেন। 
 
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একসময় এই নদে আমি ডলফিন দেখেছি। গ্রাম বাংলায় আমরা যাকে বলি শুশুক। এখন এই নদে একটি মাছও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।'
 
আক্ষেপের সুরে নিমাই চন্দ্র রায় বলেন, 'এই নদে ছোট-বড় নৌকা চলতো, আমরা নৌকায় করে হাটে যেতাম। চোখের সামনে নদটাকে আমরা মেরে ফেলেছি। এখন দেখছি নদের ওপর মাটি ফেলে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো যারা করছে, তারা নদটির কথা একবারও ভাবলো না!'

গল্লামারী বাজারের ব্যবসায়ী আতিয়ার রহমান বলেন, 'সেতুর কাজ এখনো তেমন শুরুই হয়নি। তার আগেই নদের ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধে কচুরিপানা আটকে আছে। নদের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।'

সড়ক ও জনপদ সূত্রে জানা গেছে, স্টিল আর্চ ডিজাইনের সেতু দুটির প্রতিটির দৈর্ঘ্য হবে ৬৮ দশমিক ৭০ মিটার ও প্রস্থ ১৩ দশমিক ৭০ মিটার। দুই সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৬৮ কোটি টাকা। নদের পানির স্তর থেকে সেতুর উচ্চতা হবে ৫ মিটার। সেতু নির্মাণের কাজ পেয়েছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। কার্যাদেশ অনুযায়ী আগামী ২০২৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনিসুজ্জামান মাসুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথমে দক্ষিণ পাশের বেশি পুরোনো সেতুটি ভেঙে সেখানে একটি নতুন সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এর কাজ শেষ হলে পাশাপাশি থাকা অপর সেতুটি ভেঙে সেখানেও আরেকটি সেতু নির্মাণ করা হবে।'
 
'ভাঙা সেতুর নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে এখানে। তাছাড়া পানি প্রবাহের জন্য আমরা একটি পাইপ রেখেছি, সেখান থেকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে', বলেন তিনি।

 

Comments