‘যখন এমপি হয়েছিলাম কালিগঙ্গার পানি নীল ছিল, এখন একদম কালো’ 

বুধবার বিকেলে ঢাকার সাভারে চামড়া শিল্প নগরী পরিদর্শনের পর মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এ কথা বলেন।
সাভারে চামড়া শিল্প নগরী পরিদর্শন শেষে মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। ছবি: সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, আমার নিজের এলাকায় কালিগঙ্গা নদীর পানি ৫ বছর আগে নীল রঙের ছিল। সেখানে আমরা মাছ ধরতাম, লোকজন গোসল করত। এখন একদম কালো হয়ে গেছে। ওখানে কোনো মাছও নেই, গোসল করা তো দূরের কথা।'

আজ বুধবার বিকেলে ঢাকার সাভারে চামড়া শিল্প নগরী পরিদর্শন শেষে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

পরিদর্শনের সময় তার সঙ্গে আরও ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, বিসিক চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুমার ভৌমিকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিসিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

পরিদর্শন শেষে তারা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ নেন।

সভায় সালমান এফ রহমান বলেন, 'যা হয়েছে হয়েছে, আই থিংক হাউ টু বি সলভ দ্য প্রবলেম, সে বিষয়ে আমাদের মনোনিবেশ করা উচিত। কাউকে ব্লেম করে লাভ নেই, ১০ বছর হয়ে গেছে। আমার কথা হলো কত তাড়াতাড়ি কত সুন্দরভাবে সমস্যাটা আমরা সমাধান করতে পারি সবার সহযোগিতা নিয়ে, এটাই আমাদের আজকের আলোচনার মুখ্য বিষয়।'

মতবিনিময় সভায় চামড়া শিল্পনগরীর দূষণের কথা উল্লেখ করে সালমান এফ রহমান বলেন, আমার নিজের এলাকায় কালিগঙ্গা নদী, ৫ বছর আগে আমি যখন এমপি হয়েছিলাম, কালিগঙ্গা নদীর পানি নীল রঙ্গের ছিল। ওখানে আমরা মাছ ধরতাম, আমাদের লোকজন গোসল করত। এখন যদি আপনি সেখানে যান, আমার এলাকা নবাবগঞ্জ, একদম কালো হয়ে গেছে। ওখানে কোনো মাছও নেই, গোসল করা তো দূরের কথা। আমি এই কথাটা পরিবেশ মন্ত্রীকে জানালাম। উনি বললেন যে, আমাদের সাভারের ইটিপি নিয়ে কিছু করতে হবে। আমরা শুধু শুনতেছি হচ্ছে হচ্ছে। এখন এর খারাপ যেই দিকটা, এখন তো আমার এলাকা পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে গেছে। আমাকে তো জবাবদিহি করতে হচ্ছে আমার এলাকার ভোটারের কাছে। সো সামথিং ইজ রং ইন সামহোয়্যার।'

মতবিনিময় সভা শেষে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন গণমাধ্যমকে বলেন, 'যেই যেই সমস্যাগুলো রয়েছে, আমরা সবার কথা আজ শুনেছি। আমরা চূড়ান্ত কোনো সমাধানের জন্য আজ আসিনি। আমরা আজ সরেজমিনে আজ পরিদর্শন করার (চামড়া শিল্পনগরী) জন্য এসেছি। সমস্যা এখানে বিদ্যমান, সেটি আমরা জেনেছি। এখন কীভাবে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করা যায়, সেই বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।'

তিনি বলেন, 'এটি একদিনে সমাধান করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। আবার সবকিছু বন্ধ করে দিয়েও আমরা নতুন করে কিছু করতে পারছি না। একটা নতুন বাড়ি করা খুব সহজ, কিন্তু পুরোনো একটা বাড়ি ভেঙে সেটিকে নতুন করে রি-মডেলিং করা খুব কঠিন। কাজেই এরর যেগুলো হয়ে গেছে, কন্ট্রাক্টর তো আর নেই, তারাও চলে গেছে। কাজেই এখন আমাদের এখন যে অবস্থা আছে, সব তো আর ফেলে দিতে পারব না। এর কতটুকু রক্ষা করে, পরিবেশ রক্ষা করে কীভাবে কী করা যায় সেই পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করতে যাচ্ছি।' 

মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সালমান এফ রহমান বলেন, 'আজ আমরা আসলে সমস্যা বোঝার জন্য সরেজমিনে এসেছি। আসলে সব থেকে বড় সমস্যা যেটি হয়েছে যে সিইটিপি করা হয়েছে, এটি চাইনিজ কন্ট্রাক্টররা করেছিলেন। আমরা যেই কন্ট্রাক্ট ওদের দিয়েছিলাম, তারা কিন্তু সেই অনুযায়ী কাজ করেনি। না করার কারণে তাদের যে টাকা-পয়সা (বিল) ছিল, ওটা আমরা পেমেন্ট করিনি। যেহেতু তারা কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি, এর কারণে সিইটিপির যেই পারফরম্যান্স হওয়ার কথা ছিল, সেটি সিইটিপি রিচ করতে পারেনি।'

'এখন একটা বিনিয়োগ হয়ে গেছে, এই বিনিয়োগ তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। কাজেই এটাকে কীভাবে রেট্রোফিটিং করে আরেকটা কনসালট্যান্ট দিয়ে কী করা যায়, এটা নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে। সিদ্ধান্ত কোনোটাই হয়নি। আমরা আজ সবার কাছ থেকে শুনেছি কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়,' যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'দ্বিতীয়ত কোরবানি চলে আসতেছে, কাজেই কোরবানির আগে এই ইটিপি দিয়ে কোরবানির সময় ইটিপির ব্যবহার হবে কতটুকু, কী কী করতে পারি, কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে কিছু প্রস্তাব পেয়েছি, সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সাময়িকভাবে কোরবানির সময় যে সমস্যাগুলো হয়, সেটি কিছুটা সমাধান করা যাবে।'  

পরিবেশগত সমস্যার উল্লেখ করে সালমান এফ রহমান বলেন, 'আমরা মালিকদের কথা শুনেছি, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে যদি তারা সার্টিফিকেশন না পায় তাহলে তো তারা ব্যবসা করতে পারবে না। এদিকে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কথা হলো, যদি তারা স্ট্যান্ডার্ড রক্ষা করতে না পারে, তাহলে পরিবেশ মন্ত্রণালয় কীভাবে সার্টিফাই করবে?'  

'আশার কথা হলো পরিবেশমন্ত্রী এতটুকুতে রাজি হয়েছেন, যে কিছু সময়ের জন্য অর্থাৎ কোরবানি ঈদের আগ পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ডটা একটু শিথিল করে সনদ দেবেন (পরিবেশ ছাড়পত্র)। কিন্তু তার কথা হলো, এটা চিরকালের জন্য নয়। এটা সাময়িক সময়ের জন্য অর্থাৎ কোরবানির ঈদ পর্যন্ত দিচ্ছেন। যদি কোরবানির পরে তারা স্ট্যান্ডার্ডে আসতে না পারে তাহলে এই সনদ বাতিল করা হবে,' বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, 'মালিকরা আরও সমস্যার কথা জানিয়েছেন।  আজ সবার সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। কোম্পানির এমডির কাছ থেকে শুনেছি, বিসিক চেয়ারম্যানের কাছ থেকে শুনেছি। আমরা সবার কাছ থেকেই শুনেছি, কিন্তু আরও একটু বোঝার বিষয় রয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটা মিটিং ডাকব। সেখানে সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়ে আলোচনা করে কীভাবে শর্টটার্ম, মিডটার্ম ও লংটার্মে সমস্যা সমাধান করা যায় সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করব।'

প্রধানমন্ত্রী চামড়া খাত নিয়ে আন্তরিক উল্লেখ করে সালমান এফ রহমান বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী কিন্তু চামড়া খাতকে একটা বিশেষ খাত হিসেবে দেখেন। কারণ চামড়া শিল্পে বিশেষ সম্ভাবনা আছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরাও এই খাতকে বিশেষ খাত হিসেবে দেখি। এর জন্য এই সিইপিটি সমস্যা সমাধান করতেই হবে। সমাধান না করলে চামড়া শিল্পের যে সম্ভাবনা দেখছি সে সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত দিয়েছি যে যারা ব্যক্তিগতভাবে ইটিপি করতে চান তারা ইটিপি করতে পারেন।' 

'আপনারা জানেন চামড়া রপ্তানি হচ্ছে যার ৮০ শতাংশই যাচ্ছে চায়নাতে। যেহেতু আমাদের এলডব্লিউজি সার্টিফিকেট নাই। চীনারা কিন্তু এই চামড়া থেকে ভ্যালু অ্যাড করে টাকা পাচ্ছে। আমরাও যদি এই ক্রাস্ট লেদারটা ভ্যালু অ্যাড করে রপ্তানি করতে পারি, তাহলে আমাদের রপ্তানি অনেক বেড়ে যেত। সেই বিষয়টা মাথায়ই নিয়েই আজ আলোচনা হয়েছে। এ কারণেই শিল্পমন্ত্রী ও পরিবেশ মন্ত্রীসহ আমরা একসঙ্গে বসেছি। আশা করি এ বিষয়ে সুফল আসবে,' বলেন তিনি।

মতবিনিময় সভা শেষে পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, 'এতদিন হয়ত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একটু ভিন্ন ছিল, একটু গরমিল ছিল। স্থায়ী কমিটির যে তথ্যগুলো ছিল, আমি স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে বিষয়টি নিয়ে যখন আলোচনা করেছি, সেখানে মনে হয়েছে যে পরিবেশের বিষয়গুলো এমনভাবে নিয়ে আসা হচ্ছে যে, সেখানে মনে হয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয় অপরাধী। তবে আজ সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে আমরা সবাই এখন একমত। এই সমস্যার কারণে আমাদের পরিবেশ, আমাদের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা একমত। কীভাবে এই সমস্যা আমরা সমাধান করব, সে বিষয়ে আমরা কাজ করব।'

তিনি বলেন, 'আমি পরিবেশমন্ত্রী হিসেবে পরিবেশের কথাই বলব। তারপরেও আমরা যেটা বলেছি, যদি পরিবেশের স্বার্থ কোনোভাবে কমপ্রোমাইজ না করে স্বার্থের জায়গায় আপস না করে আমরা যদি কিছু ছাড় দিতে পারি, আমরা যে মানটা নির্ধারণ করে দেই, সেখানে আমরা কিছুটা দেখব এবং ছাড় দিতে পারব।' 

'তবে এই ছাড়টা মৌলিক কোনো জায়গায় ছাড় দেওয়া হবে না। যেমন পরিবেশের ক্ষতি করছি, জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছি, এই ধরনের নীতির ক্ষেত্রে কোনো আপস হবে না। তবে আমরা চেষ্টা করব। আমরাও চাই এই শিল্পটা যেন সচল থাকে। আমরাও চাই এই খাতে যেন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, আমরাও চাই চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা বাস্তবে দেখতে। তবে আমরা এমন কোনো কাজ করব না, যেখানে মানুষের ক্ষতি হবে, জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে, পরিবেশের ক্ষতি হবে। এ ধরনের লাইসেন্স আমরা কাউকে দেব না,' বলেন তিনি।

 

Comments