বান্দরবানে বন থেকে অন্তত ২৫০ মাতৃগাছ কর্তন, দুই আ. লীগ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ

বান্দরবানের লামায় লেমু পালং খালে কাটা গাছ হাতি দিয়ে টেনে এনে রাখা হয়েছে। ছবি: স্টার

বান্দরবানের লামার বন থেকে অন্তত ২৫০ মাতৃগাছ ও বনজ ঔষধি গাছ কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। এসব গাছ বন থেকে হাতি দিয়ে টেনে নিয়ে লামা উপজেলার সরুই ইউনিয়নের লেমু পালং মৌজায় পালং খাল, শিলঝিরির ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, গত ৩০ বছর ধরেই বন থেকে গাছ কেটে পাচার করা হচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের পেছনে লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খোরশেদ আলম চৌধুরী ও উপজেলা যুবলীগের সদস্য মোরশেদ আলম চৌধুরী--এই দুই ভাই জড়িত এবং প্রশাসনের সামনে দিয়েই এসব গাছ পাচার হচ্ছে।

গাছ কাটা নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের মামলার হুমকি দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ করেন তারা।

প্রাকৃতিক যে বন থেকে গাছ কেটে নেওয়া হচ্ছে সেখানে বংশানুক্রমে বাস করেন স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষেরা।

পুরোনো বড় গাছগুলো কেটে নেওয়ার প্রভাব পড়ছে জীব বৈচিত্র্যের ওপর। এসব গাছ নিয়ে যাওয়ার জন্য পাহাড় কেটে ও ঝিরির পানির প্রবাহ বন্ধ করায় প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। পানীয় জলের সংকটে পড়ছেন স্থানীয় লোকজন।

লামায় বন থেকে অবৈধভাবে কাটা গাছ ফেলে রাখায় স্থানীয়দের পানীয় জলের উৎস ঝিরিগুলোতে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ছবি: স্টার

স্থানীয়দের অভিযোগ, গত প্রায় তিন দশক ধরেই প্রাকৃতিক এই বন থেকে হাজার হাজার গাছ কেটে নিয়েছে সিন্ডিকেট চক্র। প্রশাসন তথা বন বিভাগকে 'ম্যানেজ' করেই চলে এসব দুর্বৃত্তায়ন।

জানা যায়, পাহাড় কেটে, ঝিরির পানি প্রবাহ বন্ধ করে ২০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা তৈরি করে গাছগুলোকে ট্রাকে করে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে পাচার করা হচ্ছে।

সম্প্রতি লামার লেমু পালং মৌজার অন্তর্গত লেমু পালং খালের লাঙ্গিপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, লেমু পালং খালসহ বিভিন্ন ঝিরির ভেতর ২৫০টির বেশি মাতৃগাছের লগ রাখা হয়েছে। যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ থেকে ৫০ ফুট এবং ব্যাস ৪০ থেকে ৫০ ইঞ্চি।

এসব গাছের মধ্যে রয়েছে কড়ই, শিলকড়ই, অর্জুন, বানর খোল, শিউলি, জারুল, গর্জন, চাপালিশ, চম্পাসহ আরও নানা প্রজাতির গাছ।

ঝিরির পাশে পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে রাস্তা। গ্রামবাসীরা জানান, চোরাকারবারীরা ট্রাকে করে গাছের গুড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য এই রাস্তা তৈরি করেছে।

তবে সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে গাছ টেনে আনা হাতিগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায় চোরাকারবারীরা। তবে হাতিকে বেঁধে রাখার শেকল, খাবার সেখানেই পড়ে থাকতে দেখা যায়।

বান্দরবানের লামায় বন থেকে গাছ কেটে এনে পাচারের উদ্দেশ্যে লেমু পালং খালের পাশে জমা করা হয়েছে। ছবি: স্টার

স্থানীয়রা জানান, এই বনটি লেমুপালং মৌজায় পালংমুখ পাড়া, লাঙ্গী পাড়া, মংলাই পাড়া, হেডম্যান পাড়া, বাক্কা পাড়া, পুরাতন দেওয়ান পাড়া, নতুন দেওয়ান পাড়া, আমতলী পাড়াসহ আশপাশের ১৩টি গ্রামের মানুষের বসবাস।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বন থেকে গাছ কেটে নেওয়া সিন্ডিকেটের পেছনে আছেন লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খোরশেদ আলম চৌধুরী ও উপজেলা যুবলীগের সদস্য মোরশেদ আলম চৌধুরী – দুই ভাই।

তাদের অভিযোগ, বনের গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বা অভিযোগ করলে এই দুই ভাই মামলা করার হুমকি দেন।

বাক্কা পাড়ার কারবারী (প্রধান) বাক্কা ম্রো জানান, ২০১৫ সালে তারা গাছ লুটপাটের প্রতিবাদ করার কারণে মোরশেদ তার শ্রমিক মোহাম্মদ আজমকে দিয়ে গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করে।

'সেই মিথ্যা মামলায় আমিসহ অন্য দুই আসামি ২০২০ সালে এসে খালাস পাই।'

পুরাতন দেওয়ান পাড়ার কারবারী চোংরেং ম্রো জানান, গ্রামবাসীকে হুমকির মুখে রেখে বছরের পর বছর ধরে মোর্শেদ গাছ লুটপাট করে আসছে।

লাঙ্গি পাড়ার মাংচং ম্রো জানান, প্রতিবছর এই মৌজায় পাহাড় থেকে বনের গাছ কাটা হয়। বন বিভাগ এক পাহাড় থেকে গাছ কাটা বন্ধ করলে অন্য পাহাড় থেকে গাছ কাটা শুরু হয়ে যায়।

সরাই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মেনওয়াই ম্রো জানান, তিন মাস আগে মোরশেদ আলম তার শ্রমিকদের বন থেকে গাছ কাটতে পাঠিয়েছিল।

এ বিষয়ে মৌজার হেডম্যানকে বলা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।

লামায় পাহাড়ি ঝিরির বিভিন্ন জায়গায় কেটে রাখা হয়েছে মাতৃগাছ। ছবি: স্টার

লেমু পালং মৌজার হেডম্যান কাইং ওয়াই ম্রো জানান, আমার প্রয়াত বাবার কাছ থেকে মোরশেদ আলম নব্বই বছরের জন্য বন লিজ নেওয়ার কথা বলে বন থেকে গাছ কেটে আসছে। কিন্তু তিনি ইজারার কোনো নথি তিনি দেখাতে পারেননি।

এদিকে, বনের মাতৃগাছ ও ঔষধি গাছগুলো কেটে নিয়ে যাওয়ার কারণে ১৩টি গ্রামের মানুষের পানীয় জলের প্রধান উৎস ঝিরির পানি দূষিত হচ্ছে বলে জানান লেমু পালং মৌজার হেডম্যান কাইং ওয়াই ম্রো।

লাঙ্গি পাড়ার মেংচং ম্রো জানান, পালং খালের সঙ্গে শীল ঝিরি ও লেমু ঝিরিসহ ছোট-বড় ছয়টি ঝিরি রয়েছে।

তিনি বলেন, 'এই ঝিরি-ঝর্ণার পানির ওপরে নির্ভর করেই ১৩টি পাড়ার মানুষ বেঁচে আছে। কিন্তু বনের গাছ কেটে, গাছগুলো হাতি দিয়ে টানার কারণে হাতির মলমূত্র ঝিরির পানিতে মিশে যাচ্ছে। এই পানি ব্যবহারের কারণে গত সপ্তাহে আশপাশের কিছু মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এখন ঝিরির পানিতে গোসল করলে শরীর চুলকায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে এলাকায় পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়বে।'

গ্রামবাসীদের অভিযোগ, ওই গাছগুলো সুয়ালক-লামা সড়ক দিয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে সারুই বন বিভাগের চেকপোস্ট রয়েছে।

বনের গাছ কাটার জন্য সম্পূর্ণ নিষেধ করা হলেও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের চোখের সামনে দিয়ে সেগুলো চট্টগ্রামে পাচার করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, 'তিনি কখনো বন থেকে মাতৃগাছ কাটেননি এবং পাচারও করেননি।'

লেমু পালং খাল এলাকার বনে একটি অর্জুন গাছ কেটে রেখেছে দুর্বৃত্তরা। ছবি: স্টার

'আপনি যে গাছগুলো দেখেছেন সেগুলো আমার নয়, সেই হাতিও আমার নয়। আমি বন বিভাগের অনুমতি নিয়েই বৈধভাবে গাছের ব্যবসা করছি।'

লামার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আরিফুল হক বেলাল জানান, লেমু পালং মৌজায় গাছ লুটের খবর পেয়ে অভিযান চালানো হয়েছে।

তিনি বলেন, ওই মৌজায় গাছ লুটপাটের পেছনে মোরশেদ আলমের হাত রয়েছে বলে তারা শুনেছেন তবে তার বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।

যেহেতু তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করেনি, তাই তারা মোরশেদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেননি।

তিনি জানান, এই মৌজায় গাছ কাটার জন্য কোনো ব্যবসায়ীকে পারমিট এখনও দেওয়া হয়নি।

গাছ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সংরক্ষিত বনের বাইরের মাতৃগাছ লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে তারা মামলা করতে পারেন না। কোনো মাতৃগাছ জব্দ করলেই তারা গাছ পরিবহন আইনে মামলা করতে পারেন।'

গত বছর বন্যপ্রাণী আইনে বৃক্ষ পরিবহনে হাতি ব্যবহার করার অভিযোগে আব্দুল মালিক নামে একজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

চেকপোস্টের সামনে দিয়ে প্রাকৃতিক বনের এই মাতৃগাছগুলো কীভাবে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিনা অনুমতিতে কাটা অনেক গাছ জব্দ করা হয়েছে।

তবে তিনি স্বীকার করে বলেন, বন বিভাগের কিছু কর্মচারী সেই গাছগুলোকে চেকপোস্ট পার করার কাজে সহযোগিতা করে থাকতে পারে। এসব কাজের সঙ্গে আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণের চেয়ারপারসন (বান্দরবান চ্যাপ্টার) জুয়ামলিয়ান আমলাই বলেন, প্রাকৃতিক বন থেকে মাতৃগাছ লুণ্ঠনের জন্য বন বিভাগ দায়ী।

তিনি বলেন, বান্দরবান থেকে গাছপালা নিধন করে বনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে।

লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, অভিযোগ শোনার সঙ্গে সঙ্গে গতকাল বুধবার আমরা অভিযান চালিয়েছি সেখানে। রাস্তা দুর্গম হওয়ায় যতদূর গাড়ি নিয়ে যাওয়া গেছে ততদূর গিয়েছি। এর মধ্যে জানতে পেরেছি মোরশেদ আলমের নামে আগেও অনেক অভিযোগসহ মামলা আছে। এবারও মামলা করা হবে। পরিবেশ ও বন ধ্বংসের দায়ে পরিবেশ আইনে নিয়মিত মামলা করা হবে।

Comments

The Daily Star  | English
enforced disappearance in Bangladesh

Enforced disappearance: Anti-terror law abused most to frame victims

The fallen Sheikh Hasina government abused the Anti-Terrorism Act, 2009 the most to prosecute victims of enforced disappearance, found the commission investigating enforced disappearances.

9h ago