তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ কাটা হলো লাখ লাখ গাছ

নীলফামারীতে তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকার সংস্কার ও পরিবর্ধনের নামে কেটে ফেলা হয়েছে বিপুল সংখ্যক গাছ। ছবি: স্টার

নীলফামারী ডালিয়ায় তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় বৃক্ষ নিধন নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবিদরা। অভিযোগ উঠেছে, এক লাখের অনুমতি নিয়ে ইতোমধ্যে প্রায় চার লাখ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) 'তিস্তা সেচ প্রকল্প কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন, সংস্কার ও পরিবর্ধন প্রকল্প' ২০২১ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা।

পাউবোর তথ্য অনুসারে, এই প্রকল্পটি বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতার আংশিক ব্যাবহার করে দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ১২টি উপজেলায় সেচ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। নতুন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে এর সক্ষমতা বহুলাংশে বাড়বে।

সূত্র জানিয়েছে, নতুন প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন ধরনের সেচ খালের মোট ৭৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পাড়ের ব্যাপক সংস্কার ও সম্প্রসারণের প্রয়োজনে এর দুই তীরে অবস্থিত লক্ষাধিক গাছ কেটে ফেলার প্রয়োজনীয়তা আছে।

প্রকল্প কর্মকর্তা ও পাউবো রংপুর আঞ্চলিক অফিসের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবীব বলেন, 'বন বিভাগের সঙ্গে পাউবোর সমঝোতা অনুযায়ী এক লাখ চার হাজার গাছ কাটার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।'

গাছগুলো চিহ্নিত করে বিভিন্ন লটে ভাগ করে কাটা ও বিক্রির জন্য ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে অংশ নেওয়া একাধিক ব্যবসায়ী কার্যাদেশ পান।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, কোনো কোনো ব্যবসায়ী শুরু থেকেই চিহ্নিত এবং অচিহ্নিত বিবেচনায় না নিয়ে নির্বিচারে গাছ কাটতে শুরু করেন। ফলে প্রধান সেচ খালসহ, বিভিন্ন শাখা খাল, সেকেন্ডারি ও টারসারির (দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ অনুযায়ী বিভিন্ন খাল) দুপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে। তারা আরও অভিযোগ করেন, ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি গাছ কাটা হয়েছে। এ অশুভ কাজে পাউবো ও বন বিভাগের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী সহযোগিতা করেছেন।

এই প্রতিবেদক সম্প্রতি নীলফামারী সদর উপজেলার রামনগর, বাহালীপাড়া, জলঢাকার কাঁকড়া ও ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী গ্রাম পরিদর্শন করেন।

এসব এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গাছ কেটে ফেলায় 'মরুভূমির মতো' অসহনীয় উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কমে গেছে পাখীর সংখ্যা।

তিস্তা সেচ প্রকল্পর অন্তর্গত চাপানী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম (৭০) জানান, 'অসংখ্য বৃক্ষে আচ্ছাদিত এই এলাকাটি ছিল পাখীদের নিরাপদভূমি। গ্রীষ্মের প্রখরতায় মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী পেত ছায়া শীতল প্রশান্তি। অন্যান্য এলাকার চেয়ে এখানে আগে-ভাগেই বৃষ্টি শুরু হতো। সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে।'

বৃক্ষ নিধনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন গ্রামবাসী ও পরিবেশবিদরা।

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নদী গবেষণা সংগঠন রিভারাইন পিপল-এর পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, 'একসঙ্গে এত গাছ কেটে ফেলা পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনবে। এই আত্মবিনাশি কাজ অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।'

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের এ বিষয়ে প্রতিবাদ করেন।

তিনি বলেন, 'তিস্তা সেচ প্রকল্পের সংস্কার ও প্রশস্তকরণের নামে বেআইনিভাবে চার লক্ষাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, যা আত্মঘাতি ও ক্ষমার অযোগ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে যখন আমাদের দেশ বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে, সেই সময় এই পরিবেশ বিনাশী গাছ কাটা এই মুহূর্তে বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি।'

তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করে বলেন, বেআইনিভাবে বিপুল সংখ্যক গাছ কাটার পেছনে কোনো মহলের অবৈধ সম্পদ অর্জনের চক্রান্ত আছে কি না তা খুঁজে বের করা দরকার।

জি এম কাদেরের এই অভিযোগের বিষয়টি রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের মাসিক সমন্বয় কমিটির সভায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। সেখানে উপস্থিত বিভাগীয় বন দপ্তরের প্রতিনিধির কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। সূত্র জানিয়েছে, জবাব সন্তোষজনক না হলেও পরে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারী বিভাগীয় কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান জানান, 'বর্তমানে কিছু কারণে গাছ কাটা স্থগিত রাখা হয়েছে। আমরা যে সংখ্যক গাছ কাটবো, তার চেয়ে বেশি গাছ আমরা রোপণ করব। পরিবেশ রক্ষায় আমাদেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে।'

রংপুর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোল্লা মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি চার লক্ষাধিক গাছ কাটার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি গাছ কাটার কোনো সুযোগ নেই।'

'আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশ গাছ কাটা শেষ করেছি। তার বিপরীতে অধিক সংখ্যক গাছ, প্রায় দেড় লাখ গাছের চারা রোপণের কাজ চলমান রয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

বন বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, নব্বইয়ের দশকে তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় ছয় লাখ গাছ রোপণ করা হয়েছিল।

Comments

The Daily Star  | English
Prof Yunus in Time magazine's 100 list 2025

Prof Yunus named among Time’s 100 Most Influential People of 2025

A tribute article on Prof Yunus was written by Hillary Clinton for the magazine

2h ago