কিডনি দিবস: প্রতি ৫ লাখ মানুষের জন্য ১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক

কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসা সুবিধা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা এখনো অপ্রতুল। ফলে অনেক রোগী যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
দেশের মাত্র ৩৫টি সরকারি হাসপাতাল তুলনামূলক কম খরচে ডায়ালাইসিস সেবা দিচ্ছে এবং লাখো রোগীর চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন মাত্র ৩৫০ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিডনি রোগকে 'নীরব ঘাতক' বলা হয়। কারণ, এটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া ও জীবনসংকটজনিত জটিলতা না হওয়া পর্যন্ত সাধারণত কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না।
বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ বা প্রায় ৩ কোটি ৮২ লাখ মানুষ কিডনি রোগে ভুগছেন। এই পরিসংখ্যান ২০১৯ সালে প্রকাশিত আটটি গবেষণার পর্যালোচনার ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে।
এই রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনটি বলছে, প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয়।
সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোও কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা দেয়, তবে এতে ব্যয় অনেক বেশি, যা রোগীদের জন্য আর্থিক চাপ তৈরি করে। এছাড়া, অধিকাংশ বেসরকারি সেবাকেন্দ্র শহরে অবস্থিত, যার ফলে গ্রামাঞ্চলের বহু রোগী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হন। এতে করে বিপুল সংখ্যক কিডনি রোগী হয় যথাযথ চিকিৎসা পান না বা দেরিতে চিকিৎসা পান, যার ফলে মৃত্যুর হার বেড়ে যায়।
এই প্রেক্ষাপটে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস।
কথা মজুমদার (ছদ্মনাম) বলেন, তার পঞ্চাশোর্ধ্ব মা দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন। তবে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর তার অবস্থার আরও অবনতি ঘটে।
তারপর থেকে তিনি ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন।
তিনবার হাসপাতাল পরিবর্তন করার পর, তিনি এখন আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন। হাসপাতাল প্রতি সেশনের জন্য ৪ হাজার ৫০০ টাকা চার্জ করে। অর্থাৎ, তাদের কেবল ডায়ালাইসিসের জন্য প্রতি মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়।
তিনি বলেন, 'ইনজেকশন, রক্ত ও ওষুধের জন্য আরও ৪০ হাজার টাকা প্রয়োজন। আমাদের প্রতি মাসে ৮০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। এটি বিশাল আর্থিক চাপ।'
অন্য একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের খরচ বেশি এছাড়া তার মায়ের বয়স এবং অপারেশন পরবর্তী সম্ভাব্য জটিলতার কারণে তারা কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা বিবেচনা করেননি।
বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসচিব ও মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ফরহাদ হাসান চৌধুরী বলেন, রোগের চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ে কিডনি রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস এবং কিডনি প্রতিস্থাপনই একমাত্র চিকিৎসা।
বর্তমানে মাত্র ৩৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ এবং বিশেষায়িত হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সুবিধা আছে বলে তিনি গতকাল এক প্রেস কনফারেন্সে নিজের লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
বেশ কয়েকটি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিস সুবিধা পাওয়া গেলেও এর প্রায় ৭০ শতাংশ ঢাকায় অবস্থিত।
তিনি বলেন, 'খুব কম জেলা শহরেই এই সুবিধা রয়েছে। এজন্য, রোগীদের প্রায়ই এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে হয়। যা চিকিৎসাকে ব্যয়বহুল ও কষ্টকর করে তোলে।'
এছাড়া, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মাত্র ৩৫০ জন কিডনি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যার অর্থ প্রতি ৫ লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন বিশেষজ্ঞ।
বিপরীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৫০ হাজার মানুষের জন্য একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন; ভারতে প্রতি ৩ লাখ মানুষের জন্য একজন রয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে ফরহাদ হাসান বলেন, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের খরচে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলো প্রতি ডায়ালাইসিস সেশনের জন্য ৪০০ টাকা চার্জ করলেও, বেসরকারি হাসপাতালের খরচ ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সুবিধা অত্যন্ত অপর্যাপ্ত থাকায় অনেক রোগী বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। তবে বেশিরভাগ রোগী কেবল কয়েক মাস এই খরচ চালাতে পারেন।
ফরহাদ হাসান বলেন, তারা মুগদা হাসপাতালে প্রতিদিন মাত্র ১২০ জন রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা দিতে পারেন। যদিও বর্তমানে প্রায় ৮০০ রোগী এই সেবা নিতে অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছেন এবং তারা কখন এই সেবা পাবেন তা বলা সম্ভব না।
সংবাদ সম্মেলনে ফরহাদ হাসান আরও বলেন, ১৯৮২ সালে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হলেও দাতার ঘাটতির কারণে প্রতিবেশী দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
তিনি আরও জানান, দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বর্তমান অবস্থায় কেবল ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রোগীকে ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি প্রতিস্থাপন সুবিধা দিতে সক্ষম।
'এর অর্থ হলো প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী উপযুক্ত চিকিৎসা বা কোনো চিকিৎসা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করেন।'
প্রতিরোধ
পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুহিবুর রহমান বলেন, অনেকেই জানেন না যে তাদের কিডনি রোগ আছে।
তিনি বলেন, কিডনি ৮০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না, কারণ ক্ষতিটা ধীরে ধীরে হয়। যখন এটি শনাক্ত করা হয়, তখন দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি অ্যাডভান্স স্টেজে থাকে।
'ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অথবা কিডনি রোগের পারিবারিক ইতিহাস আছে এমন ব্যক্তিরা এবং যারা ধূমপান করেন তারা এই রোগে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ,' বলেন তিনি।
কিডনি চিকিৎসার উচ্চ ব্যয়ের কারণে, তিনি প্রতিরোধের উপর জোর দেন। তিনি পরামর্শ দেন, কিডনি রোগের প্রাথমিক শনাক্তকরণের জন্য সবাইকে অন্তত দুটি পরীক্ষা করতে হবে—রক্ত (সেরাম ক্রিয়েটিনিন) এবং প্রস্রাব (অ্যালবুমিন-টু-ক্রিয়েটিনিন রেশিও)।
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এম এ সামাদ বলেন, ১০ শতাংশ রোগী চিকিৎসার উচ্চ ব্যয় বহন করতে পারেন না।
বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক অধ্যাপক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, কিডনি দানের সুযোগ আইন দিয়ে সীমিত হওয়ায় কিডনি দাতার তীব্র ঘাটতি রয়েছে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমিতি প্রতিটি জেলায় ডায়ালাইসিস সুবিধা সম্প্রসারণ, বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং কিডনি বিশেষজ্ঞদের সময়োপযোগী পদোন্নতির আহ্বান জানিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্টের লাইন ডিরেক্টর জয়নাল আবেদিন টিটো বলেন, কিডনি রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিটি জেলা হাসপাতালে একটি করে কিডনি ইউনিট থাকা উচিত।
সরকার এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে, বলে জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর কিডনি ইউনিটগুলোকে ৫০ শয্যার ইউনিটে উন্নীত করার এবং জেলা হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
Comments