ওএমএসের ট্রাকের লাইনে আরও বেশি মানুষের ভিড়
রাজধানীর নিউমার্কেটের পাশের মুরগির দোকান সেলসম্যানের কাছে রেখে নিউ মার্কেটের ১ নম্বর গেটের কাছে গতকাল সরকারের ওপেন মার্কেট সেলের (ওএমএসের) ট্রাক থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে ছুটে যান আবুল কাশেম।
কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন আরও ২০ জন এরই মধ্যে কম দামে পণ্য কিনতে ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন।
'জিনিসপত্রের বাড়তি দাম আমাকে এখানে আসতে বাধ্য করেছে। আমার একটা ছোট ব্যবসা, তবে সেটাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না,' বলছিলেন ৫৫ বছর বয়সী কাশেম।
তিনি বলেন, এক বছর আগেও তার দৈনিক বিক্রি ছিল প্রায় ২০ হাজার টাকা, কিন্তু এখন তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
'অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আমার পাঁচ সদস্যের পরিবারের জন্য এখান থেকে কিছুটা কম দামে পণ্য কিনতে পারলে কিছুটা স্বস্তি হয়। কিন্তু আমি জানি না এজন্য আমাকে কতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে।'
১৫০ টাকায় ৫ কেজি চাল কিনতে কাশেমের প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এরই মধ্যে ট্রাকের পণ্য ফুরিয়ে গেলে অনেকেই খালি হাতে ফিরে যান।
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খাদ্যদ্রব্যের ক্রমবর্ধমান দামের ধাক্কা সামলানোই ওএমএস বিক্রি কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। রাজধানীতে চাল ও আটা বিক্রির ১১০টিসহ সারাদেশে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ৯৬৪টি এবং রাজধানীতে পেঁয়াজ, আলু, মসুর ডাল ও সয়াবিন তেল বিক্রির ৩০টি দোকান রয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, টিসিবি নিম্ন আয়ের এক কোটি পরিবার যাদের ফ্যামিলি কার্ড আছে তাদের কাছে ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করছে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্যবহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতি গত মাসে ৪৮ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশে।
টিসিবির তথ্যে দেখা যায়, গত এক বছরে সরু চালের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ২৪ শতাংশ, মোটা মসুর ডালের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ, আলু ৮৫ দশমিক ১১ শতাংশ, স্থানীয় পেঁয়াজ ১৯৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ ১৫৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
একই সময়ে চিনির দাম বেড়েছে ২৮ দশমিক ২৬ শতাংশ, লবণের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ডিমের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
নিত্যপণ্য কিনতে লাগছে দীর্ঘ সময়
গতকাল রাজধানীর ১১টি ওএমএস ও টিসিবির দোকানে গিয়ে দেখা যায়, নারী ও বৃদ্ধসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।
লালবাগের হাজী রহিম বকস লেনের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম (৭০) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বাসা থেকে বের হন আজিমপুরের অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছে ওএমএস ট্রাক থেকে পণ্য কেনার জন্য। যতক্ষণে তিনি পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছান সেখানে ততক্ষণে অনেক লোক লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে।
মনোয়ারা তার মেয়ে ও জামাতার সঙ্গে থাকেন। তার মেয়ে একজন পোশাক শ্রমিক যার মাসে আয় ৭ হাজার টাকা। জামাতা চকবাজারের একজন দোকানদার তার আয় প্রায় ৮ হাজার টাকার মতো। তারা কর্মস্থলে থাকায় মনোয়ারাকেই পণ্য কিনতে বের হতে হয়।
অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছে একটি ওএমএস ট্রাকের বিক্রয়কর্মী আবদুল কাদের বলেন, গত এক মাস ধরে ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে।
তিনি বলেন, এক মাস আগে গড়ে ১০ জন খালি হাতে বাড়ি ফিরতেন, কিন্তু এখন এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
সকাল ৮টার দিকে আব্দুল গনি রোডের কাছে একটি ওএমএস আউটলেটে আসেন ৫০ বছর বয়সী বিধবা শেফালী বেগম। তাকে ২৭০ টাকায় ৫ কেজি চাল এবং ৫ কেজি আটা কিনতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই দুটো পণ্য কিনতে খুচরা বাজার থেকে তার প্রায় ২০৫ টাকা কম পড়েছে বলে জানান তিনি।
'আমি গতকাল পণ্য কিনতে না পারায় আজকে তাড়াতাড়ি এসেছি। আমার খুচরা বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সামর্থ্য নেই,' বলেন শেফালি। প্লাস্টিক সংগ্রহ করে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে মাসে ৫ হাজার টাকার মতো আয় করেন শেফালি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ওএমএস আউটলেটে বেশি লোকের ভিড় বোঝায় যে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে।
তিনি বলেন, কিছু লোক আছে যারা ওএমএস পণ্য কেনেন এবং তাদের অন্যান্য পণ্য কেনার জন্য সেগুলো আবার বিক্রি করে দেন, যার অর্থ তাদের অবস্থা আরও খারাপ।
তিনি বলেন, 'মানুষ যখন চরম ঝুঁকিতে পড়ে তখন তারা এ ধরনের অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে।'
তিনি জনগণের আয় বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
Comments