যেভাবে ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রাম্প

ইসরায়েল যখন ইরানে হামলা শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরুতে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি এমন এক পথে এগিয়ে যান যা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলে পরিচালিত এক ব্যাপক বোমা হামলার অভিযানে রূপ নেয়।
হোয়াইট হাউসের ব্রিফিং রুমে বৃহস্পতিবার বিকেলে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট একটি বার্তা পড়ে শোনান, তিনি বলেছিলেন এটি 'সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এসেছে।'
বার্তায় ট্রাম্প বলেন, ইরানের সঙ্গে 'আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ' থাকায় মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তাই তিনি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ইরানে হামলা করবেন কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
ট্রাম্পের নিজের দলে যারা এই সংঘাতে জড়াতে চায়নি তাদের চাপের মধ্যে ছিলেন তিনি। সেদিন দুপুরে বোমা হামলার অন্যতম বিরোধী স্টিফেন কে. ব্যাননের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন ট্রাম্প। যা থেকে মনে হচ্ছিল যে ট্রাম্প হয়তো হামলা থেকে বিরত থাকবেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এর প্রায় পুরোটাই ছিল প্রতারণা। ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন এবং জটিল এই আক্রমণের জন্য সামরিক প্রস্তুতিও চলছিল পুরোদমে। লেভিট প্রেসিডেন্টের বক্তব্য পড়ে শোনানোর ৩০ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ট্রাম্প ইরানে হামলার নির্দেশ দেন। এই হামলার ফলে বিশ্বের অন্যতম অস্থির অঞ্চলের চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্পের এই 'দুই সপ্তাহ' বিষয়ক বিবৃতিটি ছিল রাজনৈতিক ও সামরিক বিভ্রান্তির বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ। ইসরায়েলের ইরানের বিরুদ্ধে প্রথমদিনের হামলা থেকে শুরু করে মিসৌরি থেকে বি-টু স্টেলথ বোমারু বিমানের ইরানের উদ্দেশ্যে উড়ে যাওয়া পর্যন্ত—এই আট দিন ধরে এটি চলে। ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর এটিই ছিল দেশটির ভেতরে প্রথম মার্কিন সামরিক হামলা।

প্রশাসনের কর্মকর্তা, ট্রাম্পের মিত্র ও উপদেষ্টারা, পেন্টাগনের কর্মকর্তা এবং এই ঘটনাগুলির সঙ্গে পরিচিত অন্যান্যদের সাথে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানা যায় যে, এই বিশৃঙ্খল সময়ে ট্রাম্পের সহযোগীদের বিভিন্ন গোষ্ঠী কীভাবে একজন অস্থির প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল। প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ, কূটনীতি, নাকি উভয়ের সমন্বয় বেছে নেবেন তা নিয়ে দোদুল্যমান ছিলেন।
ট্রাম্প সে সময় কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন, তা দেখে বাইরের পর্যবেক্ষকরা বোঝার চেষ্টা করছিলেন কোন গোষ্ঠী তখন তার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করছে। ট্রাম্প নিজেই সাংবাদিকদের আনন্দিত ভঙ্গিতে বলেছিলেন, 'তিনি ডেডলাইনের এক সেকেন্ড আগেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কারণ পরিস্থিতি বদলায়, বিশেষ করে যুদ্ধের ক্ষেত্রে।'
এরই মধ্যে, ট্রাম্প উস্কানিমূলক বিবৃতি দিচ্ছিলেন যা ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে তিনি দেশকে সংঘাতে জড়াতে চলেছেন। গত সোমবার তিনি তার নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, 'সবার তেহরান ছেড়ে যাওয়া উচিত!' পরের দিন তিনি পোস্ট করেন তিনি কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলন কোনো মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নিতে ছেড়ে আসেননি বরং 'আরও বড় কিছু'র জন্য এসেছেন।
এরপর তিনি বিশ্বকে বলেন, 'সঙ্গেই থাকুন!'
ট্রাম্পের এই ধরনের প্রকাশ্য ঘোষণায় পেন্টাগন এবং ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ডে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়ে। সামরিক পরিকল্পনাবিদরা ভাবতে শুরু করেন, ট্রাম্প হয়তো ইরানকে আসন্ন হামলার ব্যাপারে অনেক বেশি সতর্ক করে দিচ্ছেন।
তাই তারা হামলার কৌশলে বিভ্রান্তিমূলক ব্যবস্থা যোগ করেছিল। বি-২ বোমারু বিমানের একটি দ্বিতীয় দল মিসৌরি থেকে যাত্রা করে প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে পশ্চিম দিকে যাবে, যা শনিবার ফ্লাইট ট্র্যাকাররা সহজেই শনাক্ত করতে পারবে। এর ফলে অনেক পর্যবেক্ষক এবং সম্ভবত ইরানও ভুল ভেবে বসে—হামলার সময় এবং দিক সম্পর্কে, কারণ আসল হামলাটি এসেছিল একেবারে ভিন্ন দিক থেকে।
যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বৃহস্পতিবার ঘোষণা দেন যে তিনি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে তার দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে—তার আগেই হামলার প্রস্তুতি চূড়ান্ত ছিল। জ্বালানিভর্তি ট্যাংকার ও যুদ্ধবিমানগুলো নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর জন্য অতিরিক্ত সুরক্ষার ব্যবস্থাও চলছিল।
'দুই সপ্তাহ' মন্তব্যটি প্রেসিডেন্টকে শেষ মুহূর্তের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য কিছু অতিরিক্ত সময় এনে দিলেও সামরিক কর্মকর্তাদের মতে, এই কৌশলগত বিভ্রান্তি এবং বি-২ বোমারু বিমানের ভুয়া গতিপথের পরিকল্পনার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল একটি জটিল পরিস্থিতি সামাল দেওয়া — যা অনেকটাই প্রেসিডেন্টের কারণে তৈরি হয়েছিল। তিনি আক্রমণের ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন।
এই প্রতিবেদন সম্পর্কে মন্তব্য চাইলে প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলাইন লেভিট বলেন, প্রেসিডেন্ট ও তার দল 'ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো নিয়ে ইতিহাসের অন্যতম জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন।' তিনি আরও বলেন, 'অনেক প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে শুধু কথা বলেছেন, কিন্তু কেবল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই সাহস দেখিয়েছেন তা বাস্তবায়নে।'
বদলে যাওয়া সুর
ট্রাম্প প্রশাসনের শুরুর মাসগুলোতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ইরানে হামলা না করার ব্যাপারে সতর্ক করে আসছিলেন। কিন্তু গত ১৩ জুন, শুক্রবার সকালে প্রথম ইসরায়েলি হামলার কয়েক ঘণ্টা পর ট্রাম্প তার সুর পাল্টে ফেলেন।
তিনি তার উপদেষ্টাদের কাছে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রশংসা করেন, যাকে তিনি 'অসাধারণ' বলে অভিহিত করেন। 'নিখুঁত' হামলায় ইরানের সামরিক নেতৃত্বের মূল ব্যক্তিরা নিহত হন এবং কৌশলগত অস্ত্রের স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। ট্রাম্প তার সেলফোনে সাংবাদিকদের কল ধরেন এবং এই অভিযানকে 'চমৎকার' ও অত্যন্ত সফল' বলতে শুরু করেন। এমনকি তিনি ইঙ্গিত দেন যে, এই অভিযানে তার ভূমিকা অনেক বেশি ছিল—মানুষ যতটা জানে তার চেয়েও বেশি।

সেদিন পরবর্তীতে ট্রাম্প এক ঘনিষ্ঠ মিত্রের কাছে জানতে চান ইসরায়েলের এই হামলাগুলো কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে। তিনি বলেন, 'সবাই' তাকে আরও সক্রিয় হতে বলছে। এর মধ্যে তেহরানের দক্ষিণে পাহাড়ি এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ফোরদোতে ৩০ হাজার পাউন্ডের জিবিইউ-৫৭ বোমা ফেলাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পরদিন ট্রাম্প আরেক উপদেষ্টাকে বলেন, তিনি ফোরদোতে 'বাংকার বাস্টার' বোমা ব্যবহারের কথা ভাবছেন। একই সাথে তিনি এই বোমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা এবং এই ধরনের বোমা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই আছে, এই দুটি বিষয়ে গর্ববোধ করেন। সেই উপদেষ্টা কথোপকথন শেষে নিশ্চিত হন যে, ট্রাম্প ইতোমধ্যেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন।
একই সময়ে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল যে যুক্তরাষ্ট্র দৃশ্যমানভাবে যুদ্ধে জড়ালে তাদের সবচেয়ে প্রভাবশালী সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশনে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
তারা বিশেষভাবে নজর রাখছিলেন প্রভাবশালী পডকাস্টার ও ফক্স নিউজের সাবেক সঞ্চালক টাকার কার্লসনের বক্তব্যের দিকে। কার্লসন যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েলের সাথে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তার কিছু মন্তব্যে ট্রাম্প এতটাই ক্ষুব্ধ হন যে তিনি তাকে নিয়ে প্রকাশ্যে ও ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগ করতে শুরু করেন।
ট্রাম্পের রাজনৈতিক উপদেষ্টারা বিভিন্ন প্রকাশ্য ও গোপন জনমত জরিপ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাচ্ছিলেন, যেখানে দেখা যাচ্ছিল—যুক্তরাষ্ট্র ইরানে সামরিক অভিযান চালাবে কি না, তা নিয়ে জনসমর্থন অনেকটাই নির্ভর করছে প্রশ্নটি কীভাবে করা হচ্ছে তার ওপর। যদিও অধিকাংশ জরিপে দেখা যায়, আমেরিকানদের বিপুল অংশই ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না, তবুও অধিকাংশই চান না ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করুক।
ট্রাম্প নিয়মিত ফক্স নিউজ দেখছিলেন, যেখানে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের ব্যাপক প্রশংসা করা হচ্ছিল এবং অতিথিরা ট্রাম্পকে আরও সরাসরি যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। ট্রাম্পের কয়েকজন উপদেষ্টা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, কার্লসন এখন আর ফক্স নিউজে নেই, যার ফলে ট্রাম্প বিতর্কের অন্য দিকটি খুব একটা শুনতে পাচ্ছিলেন না।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে ইরানে সম্ভাব্য মার্কিন হামলা নিয়ে আলোচনা চরমে ওঠে ১৫ জুন যেদিন ট্রাম্প কানাডার জি-৭ সম্মেলনে যোগ দিতে রওনা দেন। উপদেষ্টাদের মতে, ট্রাম্প ধীরে ধীরে হামলার অনুমোদনের দিকে এগোচ্ছিলেন—যদিও একই সঙ্গে তিনি বলছিলেন, ইসরায়েল যদি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যার চেষ্টা করে সেটা হবে 'বোকামি'।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানে হামলা চালায়, তবে তার লক্ষ্য হওয়া উচিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা—সরকার পতন ঘটানো নয়।
অভিযানের গোপন তথ্য ফাঁসের বড় ঝুঁকি
তখনও পর্যন্ত, পেন্টাগন এবং টাম্পার ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ডের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের একটি ছোট দল ফোরদোর স্থাপনা এবং ইরানের অন্যান্য পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলার পরিকল্পনাগুলো নিয়ে কাজ করা শুরু করে দিয়েছিল, যা সামরিক পরিকল্পনাকারীরা কয়েক বছর আগেই তৈরি করেছিলেন।
এই পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন সেন্টকমের কমান্ডার জেনারেল মাইকেল এরিক কুরিলা এবং যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ারম্যান অব জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ জেনারেল ড্যান কেইন।

মিসৌরির হোয়াইটম্যান এয়ার বেসে অবস্থিত বি-টু স্টেলথ বোমারু বিমানগুলোই একমাত্র যুদ্ধবিমান যা ইরানি রাডারে ধরা পড়া ছাড়া জিবিউই-৫৭ বোমা ফেলতে সক্ষম। বি-২ বোমারু বিমানের পাইলটরা দূরপাল্লার এই মিশনের জন্য ব্যাপক মহড়া করেছে- যেমন, আটলান্টিক মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া, একাধিকবার জ্বালানি ভরে নেওয়া এবং শেষ পর্যায়ে ফাইটার জেটের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইরানে প্রবেশ করা।
কিন্তু সামরিক পরিকল্পনা গোপনে চলার মধ্যেই, ট্রাম্পের প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট যেন আগাম ঘটনার ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
একজন সামরিক কর্মকর্তা বলেন, প্রেসিডেন্টই ছিলেন 'অপারেশনাল সিকিউরিটির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।'
হামলার পরিকল্পনায় বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্য, সামরিক কর্মকর্তারা প্রায় একই সময়ে মিসৌরি থেকে বি-২ বোমারু বিমানের দুটি গ্রুপকে যাত্রা করানোর সিদ্ধান্ত নেন। একটি গ্রুপ পশ্চিম দিকে গুয়ামের দিকে উড়ে যাবে, তাদের ট্রান্সপন্ডার চালু থাকবে যাতে বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট কোম্পানিগুলো তাদের ট্র্যাক করতে পারে। অন্য সাতটি বোমারু বিমানের একটি গ্রুপ ট্রান্সপন্ডার বন্ধ রেখে বোমা নিয়ে পূর্ব দিকে ইরানের দিকে উড়ে যাবে, যা ধরা পড়বে না।
রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে, ইরানে হামলার কয়েক ঘণ্টা পর, জেনারেল কেইন গুয়ামের দিকে যাওয়া বহরটিকে 'ডিকয়' বা কৌশল হিসেবে উল্লেখ করেন।
আলোচনার মোড় ঘোরানো
১৭ জুনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানে হামলার বিষয়ে মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তিনি তার জবরদস্তিমূলক কূটনীতিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুমকিমূলক বার্তার মাধ্যমে।
তিনি ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট করেন, 'ইরানের আকাশ এখন আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।' তিনি আরও যোগ করেন, 'তথাকথিত সর্বোচ্চ নেতা' কোথায় লুকিয়ে আছেন, তা আমরা জানি। তিনি সহজ লক্ষ্য, কিন্তু সেখানে তিনি নিরাপদ—আমরা তাকে এখনই হত্যা করব না।'
এরপর তিনি বড় অক্ষরে লেখেন, 'নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ!'
এই সময়ে ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের মধ্যে যারা যুদ্ধবিরোধী ছিলেন তারা বুঝতে পারেন যে প্রেসিডেন্টকে সম্ভবত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত করা থেকে বিরত রাখা যাবে না। তাই তারা তাদের মনোযোগ ঘুরিয়ে এই যুদ্ধ যাতে 'ক্ষমতা পরিবর্তনের' যুদ্ধে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন।
১৭ জুন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিরিজ পোস্ট দেন, যেগুলো অনেক যুদ্ধবিরোধী উপদেষ্টা মনে করেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযানের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন এবং প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য সিদ্ধান্তকে আগে থেকেই রক্ষা করার প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

ভ্যান্স তার বহুল প্রচারিত পোস্টে লেখেন, 'তিনি (ট্রাম্প) হয়তো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করার জন্য তাকে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টেরই।'
'এবং অবশ্যই গত ২৫ বছরের বোকামিপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতির পরে বিদেশি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে মানুষের চিন্তিত হওয়া স্বাভাবিক। তবে আমি বিশ্বাস করি প্রেসিডেন্ট এই বিষয়ে কিছুটা আস্থা অর্জন করেছেন।'
প্রভাবশালী অ্যাক্টিভিস্টরা আলোচনাকে নতুন দিকে মোড় ঘোরানোর জন্য কাজ শুরু করেন। কারণ বোমা হামলার পর কী হতে পারে, তা নিয়ে একটা বিতর্ক দানা বাঁধছিল: ইরানে ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য যুদ্ধে জড়ানো উচিত কি না।
হামলার দুদিন আগে প্রভাবশালী অ্যাক্টিভিস্ট চার্লি কার্ক এক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে লিখেছিলেন, 'ক্ষমতা পরিবর্তন এই অভিযানের নতুন লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। আমেরিকার উচিত এ বিষয়ে শিক্ষা নেওয়া এবং ক্ষমতা পরিবর্তনের যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়া।'
ট্রাম্প যখন নিজের যুদ্ধংদেহী বিবৃতি পোস্ট করছিলেন, তখন টেলিভিশনে বিশেষজ্ঞদের ফোরদোতে তার সম্ভাব্য হামলার আগাম বার্তা দেওয়া দেখে তিনি বিরক্ত হচ্ছিলেন। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল যখন খবর প্রকাশ করে যে, তিনি অভিযানের সব প্রস্তুতি শুরু করার সবুজ সংকেত দিয়েছেন কিন্তু চূড়ান্ত নির্দেশ দেননি, তখন তিনি ক্ষিপ্ত হন।
বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে যোগ দেন স্টিভেন কে. ব্যানন, যিনি ইসরায়েলের সাথে ইরানের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার অন্যতম প্রধান সমালোচক। যুদ্ধবিরোধী শিবিরের কিছু আশাবাদী মানুষ এই বৈঠককে ট্রাম্পের পিছু হটার লক্ষণ হিসেবে ধরে নেন।
ব্যানন হোয়াইট হাউসে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর যখন ক্যারোলিন লেভিট ট্রাম্পের বিবৃতি পড়ে শোনান, তখন সেই ধারণা আরও জোরালো হয়। লেভিট জানান যে, ট্রাম্প সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নিয়েছেন। জটিল বিষয়ে যখন তার কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা থাকত না, তখন তিনি প্রায়শই এই ধরনের সময়সীমার কথা বলতেন।
তবে ট্রাম্প স্টিভেন কে. ব্যাননের সাথে দেখা করার আগেই লেভিটের বিবৃতিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত বিভ্রান্তি, যার উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্টের জন্য কিছুটা সময় কেনা এবং একই সাথে বোঝানো যে হামলা শিগগির হবে না।
সেই সময় পর্যন্ত ট্রাম্প ইরানের ওপর হামলা নিয়ে যারা সন্দিহান ছিলেন তাদের কথা শুনতে এবং এর সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতি—যেমন তেলের দামে প্রভাব, ইরানে গৃহযুদ্ধ এবং সম্ভাব্য শরণার্থী সংকট এবং এর পাশাপাশি প্রতিশোধমূলক হামলার সম্ভাবনা যা যুক্তরাষ্ট্রকে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে টেনে আনতে পারে—এইসব আশঙ্কা নিয়ে আলোচনা শুনতেন।
শুক্রবার বিকেলে ট্রাম্প হোয়াইট হাউস থেকে তার গ্রীষ্মকালীন প্রধান অবকাশযাপন কেন্দ্র, নিউ জার্সির বেডমিনস্টারে অবস্থিত তার ক্লাবে একটি তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানে যান। এটিও এই ধারণাকে আরও জোরালো করে যে, কোনো হামলা আসন্ন নয়।
কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে ট্রাম্প সামরিক বাহিনীকে তার ইরান অভিযান শুরু করার নির্দেশ দেন। মিসৌরি থেকে ইরানে বি-২ বোমারু বিমানগুলোর উড়তে ১৮ ঘণ্টা সময় লাগবে জেনেও তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তার কাছে মন বদলানোর জন্য আরও সময় আছে, যেমনটা তিনি ২০১৯ সালে করেছিলেন, যখন ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলার নির্দেশের পরও বাতিল করেছিলেন।
তবে তার প্রশাসনে খুব কম লোকই বিশ্বাস করেছিল যে এবার তিনি পিছু হটবেন।
একক ঘটনা নাকি নিয়মিত
একটি জটিল ও সুসংগঠিত সামরিক অভিযান শুরু হয় শুক্রবার রাতে। বি-২ বোমারু বিমানের দুটি বহর বিপরীত দিকে উড়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর, ইরানের দিকে যাত্রা করা বোমারু বিমানগুলো যুদ্ধবিমানের সাথে যোগ দেয় এবং ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে।
মার্কিন সাবমেরিন নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ৩০টি টোমাহক ক্রুজ মিসাইল ছোড়ে।
রোববার পেন্টাগনের ব্রিফিংয়ে জেনারেল কেইন জানান, বিমানগুলো ফোরদো ও নাতাঞ্জের কাছে পৌঁছালে যুদ্ধবিমানগুলো বোমারু বিমানের সামনে এসে ইরানের যে কোনো সম্ভাব্য সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল প্রতিরোধ করার জন্য আঘাত হানে।
রোববার ইরানের স্থানীয় সময় ভোররাত ২টা ১০ মিনিটে প্রধান বোমারু বিমান ফোরদো সাইটে দুটি জিবিইউ-৫৭ বোমা ফেলে। স্থাপনাটি পর্বতের গভীরে এবং কয়েকশ ফুট কংক্রিটের নিচে অবস্থিত। এই অভিযান শেষ হওয়ার আগে মোট ১৪টি 'বাঙ্কার বাস্টার' বোমা ফেলা হয়, যা যুদ্ধে প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হলো।

পেন্টাগনের কর্মকর্তারা রোববার জানান যে, আমেরিকান বোমারু বিমান ও জেট ফাইটারগুলো কোনো শত্রুর হামলার মুখে পড়েনি।
মার্কিন বিমানগুলো ইরানের আকাশসীমা ত্যাগ করার কয়েক ঘণ্টা পর, ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে বিজয়ী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, এই অভিযান ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা 'সম্পূর্ণ ও পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন' করে দিয়েছে। তিনি ইঙ্গিত দেন যে, যদি ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি ছেড়ে দেয় এবং আলোচনায় বসে তবে এই একটি অভিযান দিয়েই যুদ্ধের অবসান হতে পারে।
তবে রোববার দুপুর নাগাদ মার্কিন কর্মকর্তারা আগের রাতের আশাবাদ কমিয়ে আনেন। তারা বলেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো হয়তো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি।
ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স স্বীকার করেন, ইরানের কাছে থাকা বোমা তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়ামের মজুদ কোথায় আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তিনি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জোর দিয়ে বলেন যে, তেহরানে ক্ষমতা পরিবর্তন যার অর্থ দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়া সেটি তাদের লক্ষ্য ছিল না।
কিন্তু ট্রাম্প যার অভিযান শুধু মিত্রদের কাছ থেকেই নয়, তার কিছু সমালোচকদের কাছ থেকেও প্রশংসা পেয়েছিল, তিনি ততক্ষণে অন্য চিন্তায় চলে গেছেন। ট্রুথ সোশ্যাল পোস্টে তিনি ইঙ্গিত দেন যে, তার লক্ষ্য হয়তো পরিবর্তন হতে পারে।
তিনি লিখেছেন, 'ক্ষমতা পরিবর্তন' শব্দটি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক নয়, কিন্তু যদি বর্তমান ইরানি শাসন ইরানকে আবার মহান করতে না পারে, তাহলে কেন ক্ষমতা পরিবর্তন হবে না???'
Comments