কেন শি জিনপিং এখনো পুতিনের ‘সেরা’ বন্ধু

ছবি: সংগৃহীত

কোনো আন্তর্জাতিক চাপকে পাত্তা দিলেন না চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সবকিছুকে উপেক্ষো করে রাশিয়া সফর করেছেন। বৈঠক করেছেন কাছের রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে। কারণ, শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিন খুব পুরাতন বন্ধু। শুধু বন্ধু বললে ভুল হবে, বলতে হবে পুতিনের 'সেরা' বন্ধু শি জিনপিং। কিন্তু, তাদের এই বন্ধুত্বের রহস্য কী?

এই ২ নেতার বন্ধুত্বের রহস্যের জবাব এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। বরং তার আগে একটি তথ্য জেনে নেওয়া যাক- শি জিনপিং যখন মস্কো সফরে গেলেন তার কয়েকদিন আগেই প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তাতেও কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বরং বেশ আগ্রহ নিয়েই মস্কো সফর করেছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ এই নেতা।

এখানে বলে রাখা দরকার, গত ১৭ মার্চ পুতিনের বিরুদ্ধে ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এর ৩ দিন পর মস্কো সফর যান শি জিনপিং। আর পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অভিযোগ, ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের অবৈধভাবে রাশিয়ার ভূখণ্ডে স্থানান্তর করেছেন তিনি।

এখন প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক চাপ বা বাধা থাকা সত্ত্বেও কেন চীনের প্রেসিডেন্ট পুতিনের পাশে দাঁড়াতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ? এছাড়াও, পশ্চিমারা বেইজিংয়ের সামরিক উদ্দেশ্য নিয়েও ক্রমবর্ধমানভাবে সন্দেহ প্রকাশ করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় টিকটকের মতো চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগের চেয়ে আরও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। তবুও, কেন মস্কো সফর করলেন শি জিনপিং?

এই প্রশ্নের উত্তরে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তারে কৌশলগতভাবে রাশিয়ার কাছাকাছি থাকা প্রয়োজন চীনের।

বেইজিংয়ের নেতারা মনে করেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকারের সহায়তায় চীনের বৈশ্বিক নেতৃত্বের পথকে বাধা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি চীনের বেশিরভাগ ভৌগলিক প্রতিবেশী জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম কিংবা ভারতের ভূমিকাও এক্ষেত্রে সন্দেহজনক মনে করছে বেইজিং।

প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের রাশিয়া সফরের প্রেক্ষাপটে চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের জনগণ হুমকির মধ্যে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের মতো 'কাগুজে বাঘ' অবশ্যই চীনকে হুমকি দিতে পারবে না। একই প্রতিবেদনে, ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করলে চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকির বিষয়ে ওয়াশিংটনের সমালোচনা করা হয়েছে।

সিনহুয়ার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'যুক্তরাষ্ট্র যত বেশি ২ পরাশক্তি চীন ও রাশিয়াকে একসঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে চাইবে... চীন ও রাশিয়া তত ঘনিষ্ঠ হবে এবং একে অপরের ওপর নির্ভর করবে।'

সিনহুয়ার ওই প্রতিবেদন বা দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ক্রেমলিনের মন্তব্যও মিলে যায়। চলতি মাসের শুরুতে পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছিলেন, 'ওয়াশিংটন চায় না এই যুদ্ধ শেষ হোক। ওয়াশিংটন এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায় এবং তাই করছে। এটাই দৃশ্যমান হাত।'

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের অর্থনীতি পশ্চিমাদের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পুতিনের প্রতি শি জিনপিংয়ের অগ্রাধিকার বুঝতে হলে দুটি বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। একটি হলো বেইজিংয়ের ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি। আরেকটি হলো পুতিন ও শি জিনপিংয়ের পুরাতন ইতিহাস।

কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস থিংক ট্যাংকের সিনিয়র ফেলো এবং রুশ-চীন সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার গাবুয়েভ বলেন, 'বয়সের দিক থেকে তাদের মধ্যে মাত্র ৮-৯ মাসের ব্যবধা। তাদের দুজনের বাবাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। দুজনেই যুবক বয়সে জীবনের সঙ্গে লড়াই করেছেন। দুজনেরই কন্যা সন্তান আছে। আবার তারা ক্রমবর্ধমানভাবে দুটি দেশের শীর্ষ ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন।'

গাবুয়েভের মতে, তাদের বন্ধুত্বের শুরু হয় ২০১৩ সালে। তখন বালিতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা শীর্ষ সম্মেলনের শেষে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন শি জিনপিং। সেদিন ছিল পুতিনের জন্মদিন। হঠাৎ জন্মদিনের পার্টিতে উপস্থিত ২ জনের উদ্ধৃতি দিয়ে গাবুয়েভ বলেন, 'অনুষ্ঠানটি মোটেও জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না। তবে, তারা খুবই আন্তরিক ছিলেন, যা ছিল তাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার কার্যকরী রসায়ন।'

পুতিনের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, শি তাকে একটি কেক উপহার দিয়েছিলেন এবং তিনি ভদকার বোতল বের করেছিলেন। তারা একসঙ্গে স্যান্ডউইচও খেয়েছিলেন।

২০১৮ সালে চীনা সম্প্রচারমাধ্যম সিসিটিভিকে পুতিন বলেন, 'আমি কখনো অন্য কোনো বিদেশি সহকর্মীর সঙ্গে এভাবে সময় কাটাইনি। এখন এটি অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে, তবে প্রেসিডেন্ট শি'কে নিয়ে কথা বলতে গেলে, আমি এখান থেকেই শুরু করতে চাই।'

এই মন্তব্যগুলো বেইজিং সফরের পর করেছিলেন পুতিন। ওই সফরে পুতিনকে চীনের প্রথম ফ্রেন্ডশিপ মেডেল দিয়েছিলেন শি জিনপিং। শি বলেছিলেন, 'তিনি (পুতিন) আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে যে ওঠানামাই থাকুক না কেন, চীন ও রাশিয়া সবসময় সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিয়ে যাবে।'

এক বছর আগে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করার পরেও শি জিনপিং এসব কথাই বলে আসছেন। সর্বশেষ বেইজিং সফরে পুতিন চীনের সঙ্গে 'নো লিমিটস' পার্টনারশিপে স্বাক্ষর করেন। ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে চীনা কর্মকর্তারা রাশিয়ার সমালোচনা থেকে বিরত আছেন। এমনি তারা পুতিনের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে ন্যাটোর সম্প্রসারণকে দায়ী করেছেন।

শি জিনপিং এমন সময়ে মস্কো সফর করলেন যখন রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন অস্ত্র সরবরাহ করলে এই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতে পারে। পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে।

এছাড়া, চীন ও রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী ইউরোপের বাইরে যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়েছে। সম্প্রতি তারা ওমান উপসাগরে ইরানের সঙ্গে নৌমহড়া চালিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মস্কো সফরের পর চীন ও রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানি ক্ষেত্রে। পাশাপাশি উভয় দেশ নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্যের প্রচেষ্টা আরও বাড়াতে পারেন।

বিশ্লেষকদের ধারণা, মস্কো সফরের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারেন শি জিনপিং।

থিংক ট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো রায়ান হ্যাস লিখেছেন, বেইজিংয়ের সামগ্রিকভাবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হচ্ছে চীনের আন্তর্জাতিক অংশীদার হিসেবে রাশিয়াকে দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখা। শি মনে করেন, রাশিয়াকে চীনের অংশীদার হিসেবে গড়ে তোলা তার দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক বিষয়। আর এটি অর্জনের জন্য পুতিনের ক্ষমতায় থাকা বেইজিংয়ের জন্য দরকারি।

রায়ান হ্যাস বলেন, 'চীনের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাশিয়া ও পুতিনকে পতন থেকে রক্ষা করা।'

Comments