সংঘাত জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তির সুবাতাস’
![সংঘাত জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তির সুবাতাস’ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/04/19/iyyemen_1.jpg?itok=liltBXVh×tamp=1681875475)
সংঘাত জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যে 'শান্তির সুবাতাস' যেন সুদূর পরাহত—এমন ধারণাই দীর্ঘদিন ধরে বহন করে আসছে বিশ্ববাসী। তবে সম্প্রতি, এ ধারণা একটু একটু করে বদলে যেতে দেখা যাচ্ছে।
গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সংস্কার, কর্মসংস্থান, মানবাধিকার, অবাধ নির্বাচন ও একনায়কতন্ত্রের অবসান চেয়ে ২০১০ সালে যে 'আরব বসন্ত' উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় শুরু হয়েছিল তা পরবর্তীতে আলজেরিয়া, লিবিয়া ও মিশর হয়ে লোহিত সাগর পেরিয়ে ইয়েমেন, সৌদি আরব, সিরিয়া ও বাহরাইনের সীমায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য আরও সংঘাতময় হয়ে ওঠে।
তবে ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগর হয়ে আরব সাগর এবং ওমান উপসাগর ও পারস্য উপসাগরজুড়ে যে বিস্তীর্ণ ধূসর অঞ্চল বহু দশক ধরে অস্থিরতার 'জ্বলন্ত উনুন' হয়ে আছে, সেখানে আচমকা 'শান্তির সুবাতাস' বওয়ার আভাস দেখা দিয়েছে চীনা কূটনীতির প্রভাবে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব
মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে পুরোনো ও বড় সংঘাতের তালিকার শীর্ষে আছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব।
গতকাল মঙ্গলবার চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা শিনহুয়ার বরাত দিয়ে রিয়াদভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল আরাবিয়া জানায়, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিন গ্যাং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বলেছেন—ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে থেমে যাওয়া শান্তি আলোচনা আবার শুরুর প্রচেষ্টায় বেইজিং সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
![সংঘাত জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তির সুবাতাস’ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/04/19/saudi_iraan_cukti.jpg?itok=zi776rXM×tamp=1681875487)
শিন গ্যাং বলেন, 'রাজনৈতিক সাহস দেখিয়ে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে শান্তি আলোচনা শুরুর উদ্যোগ নিতে চীন উৎসাহ দিচ্ছে। শান্তি আলোচনায় সহযোগিতা করতে চীন প্রস্তুত।'
বেইজিংয়ের এমন বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের 'শান্তির পালে' নতুন হাওয়া জোগাবে বলে আশা করা যেতেই পারে।
সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব
আদর্শিক মতপার্থক্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বে জড়িয়ে থাকা সৌদি আরব ও ইরানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্ব ঘটনা হচ্ছে—ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি সৌদি আরবের বাদশাহ সালমানকে ইরান সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
গত সোমবার ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানির বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, ইরানের প্রেসিডেন্ট ইতোমধ্যে সৌদি আরব সফরের আমন্ত্রণ পেয়েছেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায় যে, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এই ২ প্রতিবেশীর রাষ্ট্রপ্রধানরা একে অপরকে নিজ দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অশান্তির আবরণ সরিয়ে 'শান্তির' পতাকাকে আরও সুসংহত ও সুসমুন্নত করেছেন।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশা প্রকাশ করে বলেন—আগামী ৯ মের মধ্যে তেহরান ও রিয়াদে দূতাবাস এবং মাশহাদ ও জেদ্দায় উপদূতাবাস চালু করতে রাজি হয়েছে ইরান ও সৌদি আরব।
'আরব বসন্তের' পরিবর্তনের হাওয়া সৌদি আরবে বয়ে যাওয়ার পর সুন্নিপ্রধান এ দেশটির শিয়া মতাবলম্বীরা নাগরিক অধিকারের দাবিতে পথে নামলে শাসক সম্প্রদায়ের রোষে পড়েন শিয়া নেতা নিমর আল নিমর।
সৌদি সরকার এই শিয়া নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলে এর প্রতিবাদে তেহরান ও মাশহাদের সৌদি মিশনে হামলা চলায় ইরানিরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব।
গত মাসে চীনের মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী এই ২ দেশ নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে রাজি হয়।
এর ফলশ্রুতিতে 'শান্তির সুবাতাস' বয়ে যেতে শুরু করে সানা থেকে দামেস্ক পর্যন্ত।
![সংঘাত জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তির সুবাতাস’ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/04/19/saudi_prraassttrmntrii.jpg?itok=TgK1175c×tamp=1681875501)
সৌদি-ইয়েমেন শান্তি প্রচেষ্টা
মধ্যপ্রাচ্যে আরও এক সুখবর হচ্ছে—ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা দেশটির সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বন্দি বিনিময় করেছে। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, গত ১৬ এপ্রিল শেষ হওয়া ৩ দিনের কর্মসূচিতে বিবদমান ২ পক্ষ ৮৬৯ বন্দি বিনিময় করেছে।
সন্দেহ নেই, এ ঘটনা শান্তিবাদী মানুষের মনে ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধের আশা জাগিয়েছে।
সবাই জানেন যে, 'আরব বসন্তের' প্রভাবে দেশটির দীর্ঘ সময়ের প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহর পতন হলেও এর সুফল থেকে বঞ্চিত হন ইয়েমেনবাসী।
২০১৪ সালে এডেন উপসাগরের তীরবর্তী এ দেশে জনবিপ্লবের 'ছাইভস্ম' থেকে জন্ম নেওয়া হুতি বিদ্রোহীরা সৌদি-ইরান সম্পর্ককে আরও জটিল করে তোলে। শিয়া মতাবলম্বী হুতিদের শিয়াপ্রধান ইরান সমর্থন দিলে সৌদি আরব প্রতিবেশী আরব সুন্নি দেশগুলোকে নিয়ে হুতিবিরোধী সামরিক জোট গড়ে তোলে।
ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে হুতিরা প্রতিবেশী দেশটিতে নিয়মিত হামলা করতে থাকে। ফলে কোনো দেশই নিশ্চিত বিজয়ের পথে এগোতে পারছে না।
ইয়েমেনকে ঘিরে আরও এক সুসংবাদ হলো—স্থলমাইন অপসারণের সৌদি প্রকল্প 'মাসাম'র মাধ্যমে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে হুতিদের ৮১৬টি মাইন অপসারণ করেছে।
সংবাদ সংস্থা ইয়েমেন নিউজ এজেন্সি এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সংঘাতপীড়িত দেশটিতে ৭৮২টি মাইন অপসারণ করা হয়েছে।
দীর্ঘ ৯ বছর ধরে চলা এই গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণই যখন দেখা যাচ্ছে না তখন তেহরান-রিয়াদ 'পুনর্মিলনে' এডেন উপকূলে 'শান্তির বাতাস' অনুভূত হচ্ছে।
![সংঘাত জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তির সুবাতাস’ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/04/19/jeddaa_baitthk.jpg?itok=ouPa9pTV×tamp=1681875512)
সিরিয়া-ইরাককে নিয়ে আরব 'মিলনমেলা'
তেহরান-রিয়াদ সুসম্পর্কের প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে, বহির্বিশ্ব থেকে প্রায় ১২ বছর বিচ্ছিন্ন থাকা সিরিয়ার ইরানপন্থি বাশার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে গড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো।
গতকাল সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানায়, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ দামেস্কে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সঙ্গে দেখা করেছেন।
এ ঘটনা প্রায় এক যুগ ধরে 'এক ঘরে' হয়ে থাকা সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়তা করবে। বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা সিরিয়াকে আরব সমাজে ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
এর এক সপ্তাহ আগে সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদি আরব সফর করেছিলেন।
গত ১৪ এপ্রিল আল জাজিরা জানায়, সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এবং আরব দেশগুলোর জোট আরব লিগে দামেস্ককে ফিরিয়ে আনতে প্রভাবশালী ৯ আরব দেশের প্রতিনিধিরা সৌদি আরবের বন্দরনগরী জেদ্দায় বৈঠক করেছে।
'আরব বসন্তের' প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ২০১১ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে পদত্যাগের দাবি জানায় গণতন্ত্রপন্থিরা। সুন্নিপ্রধান সিরিয়ায় শিয়া মতাবলম্বী প্রেসিডেন্টকে সরাতে গিয়ে আন্দোলনকারীরা ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আরব লিগ থেকে সিরিয়াকে বহিষ্কার করা হয়।
দেশটিতে গৃহযুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৫ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে এবং মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে।
![সংঘাত জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তির সুবাতাস’ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2023/04/19/iraak_o_saudi_prraassttrmntrii.jpg?itok=8lS-zfzS×tamp=1681875528)
প্রায় ১ যুগ ধরে চলা এই সংঘাতেরও কোনো রাজনৈতিক সমাধান না মেলায় এখন আরব নেতারা আসাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সিরিয়ার মতো অপর ইরানপন্থি দেশ ইরাকের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী আরব সরকারগুলো।
ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসনের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ২০ মার্চ আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, শিয়াপ্রধান আরব দেশ ইরাকের ওপর প্রতিবেশী ইরানের প্রভাব কমাতে সুন্নি আরব দেশগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক আরব সেন্টারের গবেষণা ও বিশ্লেষণ বিভাগের পরিচালক ইমাদ হার্ব সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, 'ইরান ও সৌদি আরবের মধ্য সমঝোতা চুক্তি পারস্য উপসাগরের তীরে আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।'
তিনি জানান, সিরিয়া ও লেবাননের সঙ্গে ইরাকের সুসম্পর্ক আছে। এছাড়াও, জর্ডান ও মিশরের সঙ্গে বাগদাদের আছে কৌশলগত অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
সংবাদ প্রতিবেদনে জানা যায়, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও চেষ্টা করছে ইরাকের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এমন প্রত্যাশা করা যায় যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলে সেখানে বহুল প্রত্যাশিত শান্তির 'সোনার হরিণ' ধরা দিতে পারে।
করোনা মহামারি ও ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরাশক্তি চীনের এই শান্তি প্রচেষ্টা বিশ্বের অন্যতম 'সংঘাতক্লিষ্ট' অঞ্চলটিতে শান্তি আনতে মূল ভূমিকা পালন করছে।
এমনটিও আশা করা যায় যে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বিরাজ করলে তা প্রবাসী শ্রমিকদের জন্যও আশীর্বাদ হয়ে উঠবে, যা সেই অঞ্চলে বাংলাদেশিসহ অন্যদের জন্য কাজের আরও সুযোগ সৃষ্টি করবে।
Comments