বাংলাদেশের ইতিহাসে হেনরি কিসিঞ্জারের প্রভাব

হেনরি কিসিঞ্জার
হেনরি কিসিঞ্জার। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

গত ২৯ নভেম্বর ১০০ বছর বয়সে মারা যাওয়া হেনরি কিসিঞ্জারকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হয়েছে নানান প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষমতাধর।

সে দিনগুলোয় কিসিঞ্জার কী করেছিলেন, কিংবা তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কী করেননি—তা বেশ বড় আকারে প্রভাব ফেলেছে আমাদের দেশের ইতিহাসে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কিসিঞ্জার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে যখন বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে বাংলাদেশ হিমশিম খাচ্ছে, সে সময়টিতে তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যখন পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন।

যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ ও দেশটির কংগ্রেসে এই অন্যায়ের বিরোধিতা করলেও প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শকের ভাবনা ছিল ভিন্ন। তারা পাকিস্তানিদের কার্যক্রমকে সমর্থন করেছিলেন। এর পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কে পাকিস্তানের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা৷

এই সম্পর্ক স্থাপনের কারিগর ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। তিনি একাধারে এর স্বপ্নচারী ও বাস্তবায়নকারী। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা কিসিঞ্জার এই সম্পর্ককে এতটা প্রাধান্য দেওয়ায় বিষয়টি পরোক্ষভাবে বাংলাদেশি জনগণের দুর্ভাগ্যের কারণে রূপান্তরিত হয়।

হেনরি কিসিঞ্জার
হেনরি কিসিঞ্জার। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

১৯৭১ এর গ্রীষ্মে কিসিঞ্জার এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে ভারতে যান। সেখানে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে ভারতের মনোভাব যাচাই করেন।

এরপর তিনি পাকিস্তান সফর করেন। সেখানে একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে চমকপ্রদ এক মতবিনিময় হয় তার। ইয়াহিয়া যখন তার কাছে জানতে চান, কিসিঞ্জার তাকে একনায়ক মনে করেন কিনা- জবাবে কিসিঞ্জার বলেন, 'আমি নিশ্চিত নই। আপনি যদি আদতে একজন একনায়ক হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি নির্বাচন আয়োজনে খুব একটা পারদর্শী নন।'

এই বাক্যালাপ থেকে আমরা কিসিঞ্জারের মনোভাব সম্পর্কে জানতে পারি—ঠিক কীভাবে তিনি এ অঞ্চলের পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি ছিলেন এমন মার্কিন কূটনীতিক, যার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল। এ ক্ষেত্রে একনায়কের অপকর্ম বা জনগণের দুর্দশাকে বিবেচনায় নেওয়ার চিন্তা তার মাথায় আসেনি।

এই সাক্ষাতের সময়ই কিসিঞ্জারের পাকিস্তান থেকে গোপনে চীনে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। রিচার্ড নিক্সনের ১৯৭২ সালের চীন সফরের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নির্ধারণ করতেই তিনি সে সময় সেখানে যান।

১৯৭১ সাল জুড়ে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারেই কিসিঞ্জার ও হোয়াইট হাউসকে তৎপর হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানের চালানো গণহত্যাকে তারা দেখেছেন বাড়তি ঝামেলা হিসেবে।

হেনরি কিসিঞ্জার
হেনরি কিসিঞ্জার। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

যুক্তরাষ্ট্র ধরে নেয়, গণহত্যার বিপক্ষে অবস্থান নিলে চীনের সঙ্গে আলোচনায় তাদের মূল্য মধ্যস্থতাকারী ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে।

নিক্সনের প্রশাসন দ্ব্যর্থহীনভাবে এই অবস্থানই ধরে রাখে। কারণ স্নায়ুযুদ্ধে তাদের নতুন সঙ্গী চীন পাকিস্তান সরকারের কার্যক্রমকেই সমর্থন দিতে থাকে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আনা প্রস্তাবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে বাংলাদেশের বিজয়ের পথ বন্ধ করার চেষ্টা করে। তবে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে এই প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়।

বহু বাংলাদেশির কাছে হেনরি কিসিঞ্জার কুখ্যাত মানুষ। তিনি বাংলাদেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' আখ্যায়িত করে নিন্দা কুড়ান। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে এক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ইউ অ্যালেক্সিস জনসন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি'র সঙ্গে তুলনা দেন। ইংরেজিতে তিনি 'বাস্কেট কেস' শব্দাংশ ব্যবহার করেন।

১৯৭২ সালের যুদ্ধপরবর্তী সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে বাংলাদেশের বৈশ্বিক সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে, এই প্রসঙ্গটি কিসিঞ্জারে সামনে তুলে ধরা হলে তিনি জানান, এই 'ঝুড়ির' দায় যুক্তরাষ্ট্রকেই নিতে হবে, বিষয়টি এমন নয়।

অনেকের কাছেই হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন আদ্যোপান্ত 'রিয়েলপলিটিক'—বাস্তব রাজনীতির প্রচারক, যার কাছে সামনে থাকা বাস্তবতা ও নিজ স্বার্থ রক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; এ ক্ষেত্রে মানবিকতা, নৈতিকতা বা অন্য কোনো বিষয় প্রাধান্য পায় না। এবং এটাই সত্য এই যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানবিক বিপর্যয় দূর করার উদ্যোগ নেওয়া বা এর নিন্দা জানানোর পরিবর্তে নিজেদের কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জনই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই নীতি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কিসিঞ্জার।

তার এই অবস্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে তাকে নির্দয় ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি নিজেই তার এই অবস্থান তৈরি করেছেন।

ইংরেজি থেকে ভাবানুবাদ করেছেন মাহমুদ নেওয়াজ জয়

 

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

4h ago