২০২৩ গেল যুদ্ধ-বিগ্রহে, ২০২৪ সাল কি আরও খারাপ হতে যাচ্ছে

কোভিড পরবর্তী বিশ্ব বেশ ক্লান্ত। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, তহবিলের স্বল্পতা থেকে শুরু করে চলমান যুদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতায় বেশ উত্তেজনাপূর্ণ কেটেছে ২০২৩ সাল। তবে বছরটি আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারতো। কিন্তু একটি ব্রেকিং পয়েন্টে পৌঁছানোর আগেই ২০২৪ সাল এসে হাজির। যেখানে অপেক্ষা করছে বড় কিছু সঙ্কট।
ইংরেজি নতুন বছরের আগের ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ইসরায়েলের হামলায় শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ছবি: এএফপি

কোভিড পরবর্তী বিশ্ব বেশ ক্লান্ত। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, তহবিলের স্বল্পতা থেকে শুরু করে চলমান যুদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতায় বেশ উত্তেজনাপূর্ণ কেটেছে ২০২৩ সাল। তবে বছরটি আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারতো। কিন্তু একটি ব্রেকিং পয়েন্টে পৌঁছানোর আগেই ২০২৪ সাল এসে হাজির। যেখানে অপেক্ষা করছে বড় কিছু সঙ্কট। 

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ এখনো সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকায় সংঘর্ষটি বড় আকারে ছড়িয়ে পড়েনি, যেমনটা অনেকেই ধারণা করেছিলেন। 

যদিও ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ'র সঙ্গে লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে প্রায়ই গোলা বিনিময় হচ্ছে। তবে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধের জন্য গঠিত এই গোষ্ঠীটি ২০ হাজার গাজাবাসী মারা যাওয়ার পরও পুরোপুরিভাবে যুদ্ধে জড়ায়নি। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। যেমন, বছরের পর বছর সিরিয়া এবং অন্যান্য জায়গায় সংঘর্ষে জড়িয়ে থাকার কারণে হিজবুল্লাহ বেশ ক্লান্ত। এ ছাড়া, ইরান থেকে কম অর্থায়ন, ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ের ফলে লেবাননে ভারী বোমা পড়ার আশঙ্কাসহ নানা কারণ রয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিজবুল্লাহর প্রধান সমর্থক ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি বড় লড়াইয়ে নামতে এখনো আগ্রহী নয়। কেননা ইরান নিজস্ব কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া, ইরান এখনো তাদের প্রধান সামরিক নেতা কাশেম সোলাইমানিকে হারানোর ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে, ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে এসেছে এবং দ্রুত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। যদিও এর আগে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করবে না বলে জানিয়েছিল। তবে মার্কিন বিশ্লেষকরা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা এবং সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। 

২০২৪ সালে ইরানের পারমাণবিক বোমার সম্ভাব্য বিকাশ এই অঞ্চলের পরবর্তী সঙ্কটে পরিণত হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, সেক্ষেত্রে তাদের জবাব দেওয়ার জন্য হিজবুল্লাহকে আপাতত সংরক্ষিত করে রাখা হচ্ছে। 

অপরদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনের এই পরিস্থিতিতে প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করছে, কিন্তু যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তারা পরিস্থিতিটিকে সক্রিয়ভাবে সম্বোধনের চেয়ে স্থিতিশীলতা, ইরানের বিরুদ্ধে ঐক্য এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বজায় রাখার বিষয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। 

২০২৪ সালে আরেকটি প্রধান উদ্বেগজনক সিদ্ধান্ত আসতে পারে ইসরায়েলের কাছ থেকে। তাদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য এবং মার্কিন সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে হিজবুল্লাহকে আক্রমণের আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এতে উভয় পক্ষের প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বেসামরিক নিহতের সংখ্যা হবে আকাশচুম্বী। এই সংঘর্ষের সম্ভাবনা ২০০৬ সালের ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধের পর থেকেই তৈরি হচ্ছে। তবে ঘটনাটি এখন ঘটার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। 

মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনা সত্ত্বেও, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এখনো মূল বৈশ্বিক নিরাপত্তা সমস্যার একটি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিলম্বিত সাহায্য ইউক্রেনের মনোবলে বেশ আঘাত হেনেছে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় ন্যাটোর যথেষ্ট বিনিয়োগ সত্ত্বেও এটি প্রয়োজনীয় ফলাফল দেখাতে পারেনি।

ইউক্রেন আরও ৫ লাখ সেনা মোতায়েনের কথা ভাবছে। অন্যদিকে, রাশিয়া আত্মঘাতী মিশনের জন্য সু-প্রশিক্ষিত অপরাধীদেরও নিয়োগ দিচ্ছে। হতাহতের ক্ষেত্রে মস্কোর সহনশীলতা এবং এর দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ যুদ্ধক্ষেত্রে এর পুনরুত্থানকে শক্তিশালী করছে। 

পশ্চিমা সমর্থন এবং অর্থায়ন হ্রাস পেতে শুরু করায় এটা স্পষ্ট যে, কিয়েভ আসন্ন শীতকালে একটি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। পশ্চিমা সহায়তা ছাড়া তারা বেশিদিন প্রতিরোধ করতে পারবে না। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কির সঙ্গে তার সামরিক প্রধানের সম্পর্ক প্রশাসনের মধ্যে গভীর বিভাজন প্রকাশ করছে। অতীতের ব্যর্থতার জন্য তারা একে অপরকে দোষারোপ করছে। 

২০২৩ সালের যুদ্ধের সঙ্কটগুলো ২০২৪ সালে আরও গভীর হতে যাচ্ছে। পশ্চিমা সহায়তা হ্রাস, ইউক্রেনের পতন ত্বরান্বিত করবে কি না, তা পরের বছরই প্রকাশ পাবে। তবে এই যুদ্ধের ফলাফলের প্রভাব ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিসীম। রাশিয়া ইউক্রেন দখল করে নিলে তারা ন্যাটোর সীমানার কাছাকাছি চলে আসবে। যা নতুন কোনো সংঘাতের জন্ম দেবে কি না, তা দেখা এখন সময়ের দাবি। 

তবে স্বস্তির বিষয় এই যে, চীন এখনো তাইওয়ান আক্রমণ করেনি। যদিও ফিলিপাইনের কাছাকাছি এবং দক্ষিণ চীন সাগরে তারা সামরিক মহড়া চলমান রেখেছে। চীন মূলত নিজের দেশের ভেতর কিছু সঙ্কটের সম্মুখীন। বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যা এবং সঙ্কুচিত কর্মশক্তির কারণে বেইজিং একটি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাগত সঙ্কটের মুখোমুখি। যা সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটাতে পারে। শি জিনপিংয়ের 'চীনা স্বপ্ন' চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে দেশটি আগ্রাসী বৈদেশিক নীতির দিকে ঝুঁকতে পারে।

তবে তাইওয়ানের আসন্ন নির্বাচনে বাইডেন মার্কিন সেনা পাঠানোসহ এটিকে সমর্থন দেবে বলে প্রকাশ্যে জানিয়েছে। যা তাইওয়ানের ভবিষ্যতকে আরও অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। সেক্ষেত্রে আগামী বছর চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের সমস্যাটি আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। 

বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিগুলোর সম্পর্ক এখন সাপে-নেউলে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইসরায়েল, ভারত, পাকিস্তান এবং উত্তর কোরিয়া প্রত্যেকের পরিস্থিতিই উত্তেজনাপূর্ণ। 

ভারতে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা বৃদ্ধি, তার পাশেই পাকিস্তান ইসলামবাদী বিদ্রোহ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হয়ে আছে। অন্যদিকে, পূর্ব ইউরোপে আক্রমণের জন্য উত্তর কোরিয়া মস্কোতে পুরোনো কামান সরবরাহ করছে। পাশাপাশি তারা জাপানের ওপরও রকেট নিক্ষেপের মতো কর্মকাণ্ড করছে। যা অঞ্চলটিতে অস্বস্তি বাড়াচ্ছে।

বিশ্ব গত কয়েক দশকের তুলনায় বেশ অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও, আশার কথা হলো যে- সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিগুলো এ বছর উন্মোচিত হয়নি। অদূর ভবিষ্যতেও যেন না হয়, সেটাই প্রত্যাশা। 

তথ্যসূত্র: সিএনএন

গ্রন্থনা: আহমেদ বিন কাদের অনি

Comments