পাকিস্তানের ‘ভোট বিপ্লবে’ ইমরানের সাফল্যের যত কারণ

পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে ঘোষিত ২৬৪ আসনের ফলাফলে সবচেয়ে বেশি ১০১টি আসন পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই প্রার্থীদের ৯৩ জনই কারান্তরীণ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত।

বিশ্লেষকদের ভাষ্য, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে পিটিআইয়ের শক্ত অবস্থান ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে, যা পাকিস্তানের রাজনীতিকে একটি নতুন মেরুকরণের সামনে দাঁড় করিয়েছে।

অথচ এই নির্বাচন ঘিরে ইমরান খানের সামনে প্রতিবন্ধকতার শেষ ছিল না। পিটিআইয়ের ক্ষমতা খর্ব করতে সেনাবাহিনী তাদের প্রতিটি অস্ত্র ব্যবহার করেছে। পিটিআইয়ের দলীয় প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট বাতিল করা হয়েছে। কারাবন্দী করা হয়েছে দলের অন্য অনেক নেতাকেও।

আর মূলধারার গণমাধ্যমেও পিটিআইয়ের জায়গা ছিল না। নেতাদের ওপর ছিল আনুগত্য পরিবর্তন কিংবা রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার প্রবল চাপ। সবমিলিয়ে আক্ষরিক অর্থেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে পিটিআইকে মুছে ফেলার সব চেষ্টাই করা হয়েছে নির্বাচনের পুরো সময়জুড়ে।

তা সত্ত্বেও নির্বাচনে ইমরান খান ও পিটিআইয়ের অভাবনীয় সাফল্যের কারণগুলো ঠিক কী কী—তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খানের সঙ্গে।

এ বিষয়ে এম হুমায়ুন কবির বলেন, 'আমরা জানি যে ইমরান খানের দল যাতে নির্বাচনে ভালো ফল করতে না পারে তার জন্য সামরিক বাহিনী যথেষ্ট পরিমাণ চাপে রেখেছিল তাদের। এমনকি দলটির নির্বাচনী প্রতীকও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।'

'তারপরেও নির্বাচনে পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীদের সাফল্যের কারণ, পাকিস্তানের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু এখনো কম-বেশি কার্যকর আছে। সে কারণেই নির্বাচন কমিশন সময়ে সময়ে ফলাফল ঘোষণা স্থগিত রাখলেও আমার ধারণা চাপ দিয়েও তাদের কাজ করানো যায়নি। এর বাইরে দেশটির বিচার বিভাগ নিজস্ব অবস্থান ধরে রেখে অন্তত গত দুই দশকে বিভিন্ন ভালো উদাহরণ তৈরি করেছে।'

সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, 'এই নির্বাচন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে হয়নি। ফলে সামরিক বাহিনীসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো চাপ দিয়ে সবটা দখল করার সুযোগ পেয়েছে বলে মনে হয় না। সে কারণেই পাকিস্তানের জনগণ একটি বিশেষ সংস্থার অনুগ্রহ পেয়ে আসা নওয়াজ শরীফকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে মনে হয়। অনেকটা একই ঘটনা ঘটেছে পাকিস্তান পিপলস পার্টির ক্ষেত্রেও।'

হুমায়ুন কবিরের ভাষ্য, 'নির্বাহী প্রতিষ্ঠানগুলো মোটামুটি চাপের মুখেও কাজ করতে পেরেছে। প্রচলিত সুবিধাবাদী রাজনীতিতে যে গোষ্ঠীগুলো আছে তার বিরুদ্ধে ইমরানের অবস্থানকে মানুষ ইতিবাচকভাবে নিয়েছে, তার প্রতি তারা সমর্থন জানিয়েছে। এটা যত না ইমরানের পক্ষে সমর্থন, তার চাইতে বেশি অন্য গোষ্ঠীগুলোর প্রতি অনাস্থা। ইমরান এটা জানতেন। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্ম ব্যাপকভাবে এই ভোটে অংশ নিয়েছে; যাদের সমর্থন ছিল ইমরানের প্রতি।'

এই নির্বাচন নিয়ে সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের পর্যবেক্ষণ হলো, 'পাকিস্তানে আরেকটা সত্তরের মোমেন্ট তৈরি হয়েছে। ওই নির্বাচনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যা প্রত্যাশা করেছিল তার ফল হয়েছিল ভিন্নরকম। এবারও সেই একইরকম হচ্ছে। কাজেই এটা খুব ভাগ্য নির্ধারণী মুহূর্ত পাকিস্তানের রাজনীতির জন্য। এটাকে যদি তারা সঠিকভাবে উত্তরণের দিকে নিয়ে যায় তাহলে তা দেশটির জন্য ইতিবাচক হবে।'

অধ্যাপক সাহাব এনাম খানও মনে করেন, পাকিস্তানের নির্বাচনী ইতিহাসে এটা একটি নতুন মুহূর্ত। তার মতে, পাকিস্তানে যে নির্বাচনটা হয়ে গেল, তা ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচন। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচন ছিল না।

সাহাব এনাম বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন এভাবে—'জনগণ এখানে দুটো বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে। পাকিস্তানে সামরিক রাজনীতির বিরুদ্ধে যে অনাস্থা, সেটার একটা প্রায়োগিক প্রতিফলন ঘটেছে এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে। দ্বিতীয়ত, ইমরান খানের যে ক্যারিশমেটিক লিডারশিপ আছে বিরোধী দল হিসেবে কিংবা সরকারি দল হিসেবে- ওই ক্যারিশমেটিক রোলটা পাকিস্তানের সমাজ অ্যাপ্রিসিয়েট করে। তাই বলা যায় এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানের সমাজে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিস্তর পরিবর্তন এসেছে।'

এই অধ্যাপক মনে করেন, এই পরিবর্তনের মূল কারণটা হলো অর্থনীতি। তিনি বলেন, 'এই অর্থনীতির জায়গা থেকে তারা (পাকিস্তানের জনগণ) গুরুত্ব দিয়েছে ক্যারিশমেটিক লিডারশিপ কার কাছে আছে তার ওপর। এটা বিলওয়াল হতে পারত। কিন্তু তার তো সেই ক্যারিশমা নেই।'

'রাজনীতিতে আসার পর থেকে ইমরানের সামনে সবসময় সুনির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য ছিল। সেটা হলো সামরিকতন্ত্র থেকে দেশের অর্থনীতিকে বের করে নিয়ে আসা এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য নির্ভরতা কমানো। সেইসঙ্গে আরেকটা বিষয় এসেছে। সেটা হলো ইমরান খান নিজে অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধি হয়েও সাধারণের কাতারে নিজেকে নামিয়ে আনতে পেরেছেন। যেটা নওয়াজ শরীফ কিংবা বিলওয়াল ভুট্টোর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এছাড়া পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি প্রগতিশীল এবং বাস্তববাদী। তাদের সমর্থন ইমরান পেয়েছেন।'

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কিংবা 'এলিটিস্টরা' বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে ইমরান সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও তা আদতে কার্যকর হয়নি মন্তব্য করে অধ্যাপক সাহাব এনাম বলেন, 'নির্বাচনের এই ফলাফল একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রাখবে পাকিস্তানের রাজনীতি। তবে (পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির মতো) প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসতে অনেক সময় লাগবে। কারণ মিলিটারি এলিটিজম থেকে বেরিয়ে আসার মতো সক্ষমতা তাদের এখনো তৈরি হয়নি।'

 

Comments

The Daily Star  | English
Iran state TV live broadcast resumes after Israeli attack

Iran condemns Israeli attack on state TV as 'war crime'

The blast occurred as the presenter was live on TV lambasting Israel

1h ago