‘যেন বিশাল কোনো বজ্রপাত, তাকিয়ে দেখি আগুনের বড় গোলা’

বিরোধপূর্ণ কাশ্মীরকে বিভক্ত করা ভারত ও পাকিস্তানের অস্থির সীমান্তের দুই পাশে বসবাসকারী মানুষ গত কয়েকদিন ধরেই যুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটক নিহতের ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করছে ভারত। সেইসঙ্গে সামরিক শক্তির মাধ্যমে এর প্রতিশোধ নেওয়া হবে বলে জানায় দেশটি। এরপর থেকেই সীমান্তের বাসিন্দারা যেন আন্দাজ করতে পারছিলেন, যেকোনো মুহূর্তে দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হতে পারে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী গ্রামে বসবাসকারী বাসিন্দারা বাঙ্কার প্রস্তুত করছিলেন এবং জরুরি রসদ মজুদ করছিলেন। বুধবার মধ্যরাত ১টার দিকে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্রের তীব্র শব্দ এবং সীমান্ত এলাকা ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠলে তারা বুঝতে পারেন পাকিস্তানে ভারতের হামলা শুরু হয়ে গেছে।
মধ্যরাতের হামলার বিষয়ে ভারতের কাশ্মীরের দক্ষিণের জেলা পুলওয়ামার উয়েন গ্রামের বাসিন্দারা জানান, 'আকাশ থেকে একটা কিছু যেন পড়ল, মনে হচ্ছিল উড়োজাহাজ। তারপর আগুন নেভাতে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ফায়ারফাইটারদের পাঠানো হয়।'
এটি সামরিক এয়ারক্রাফট কি না, কর্মকর্তারা তা নিশ্চিত করতে অস্বীকৃতি জানালেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মধ্যরাতে তারা বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবিমানের শব্দও শোনা গেছে।
'মনে হচ্ছিল বিশাল কোনো বজ্রপাত যেন। বাইরে তাকিয়ে দেখি বিশাল এক আগুনের গোলা,' বলেন স্থানীয় এক বাসিন্দা।
এরপরই দ্রুত ভারত ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বরাবর ভারী গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে যায়।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের চৌকিবাল এলাকার বাসিন্দা ওয়াহিদ আহমদ বলেন, 'গোলাবর্ষণে আমাদের পুরো এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক পরিবার পালিয়ে যায়, অন্যদের কর্তৃপক্ষ সরে যেতে সাহায্য করে। যদিও সকালের মধ্যে গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে, তবে মানুষ এখনও আতঙ্কে আছে।'
পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের বাসিন্দারা বলছেন, কোনো ধরনের পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই ভারত হামলা চালিয়েছে।
পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদ নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে মাত্র ২৩ কিলোমিটার দূরে। সেখানে প্রথম বোমাটি পড়ে পাহাড়ের ওপর একটি মসজিদে। বিবিসিকে সেখানকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ওয়াহিদ বলেন, 'আমি তখন গভীর ঘুমে। বিস্ফোরণে আমার ঘর কেঁপে ওঠে।'
'আমি দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসি, দেখি অন্যরাও বাইরে বের হয়ে গেছেন। আমরা তখনও বুঝে উঠতে পারিনি কী হচ্ছে। এর মধ্যেই আরও মিসাইল আঘাত হানে। এতে চারদিকে আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে।'
ওয়াহিদ জানান, আহতদের ২০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। 'শিশুরা কাঁদছে, নারীরা ছোটাছুটি করছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। আমরা সবাই আতঙ্কিত, কী করব জানি না। মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। চারপাশে শুধু অনিশ্চয়তা।'
এক বিবৃতিতে ভারতের সেনাবাহিনী দাবি করেছে হামলা হয়েছে 'সন্ত্রাসী অবকাঠামো' লক্ষ্য করে। তবে, ওয়াহিদ বলেন, তিনি বুঝতে পারছেন না কেন মসজিদে হামলা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'এটা পাড়ার একটা সাধারণ মসজিদ, যেখানে আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম। এর আশেপাশে কখনও কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখিনি।'
'নিরন্তর ভয়ে দিন কাটছে'
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় মুজাফফরবাদ শহরের কর্মকর্তারা ভারত থেকে সম্ভাব্য বিমান হামলার আশঙ্কায় শহরজুড়ে প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। বাসিন্দারা মাটির দেয়ালযুক্ত ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার প্রস্তুত করেছিলেন, সামর্থ্যবানরা বানিয়েছেন কংক্রিট দিয়ে।
জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে ওই অঞ্চলের খাদ্য বিভাগকে দুই মাসের খাদ্য সরবরাহ মজুদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং মাদ্রাসাগুলো কমপক্ষে ১০ দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হামলার সময় প্রস্তুত থাকতে এবং কেউ আহত হলে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে মুজাফফরবাদের জরুরি সেবাকর্মীরা স্কুলশিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছের চকোঠি এলাকার দোকানদার ইফতিখার আহমেদ মীর বলেন, 'এক সপ্তাহ ধরে আমরা ক্রমাগত আতঙ্কের মধ্যে আছি, বিশেষ করে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে।'
তিনি বলেন, 'স্কুল শেষে যেন তারা কোথাও না যায়, সোজা যেন বাড়িতে ফিরে আসে, আমরা সেটাই খেয়াল রাখছি।'
Comments