নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধান

ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে গাজা যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করেছেন নেতানিয়াহু

ছবি: এএফপি

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের রক্তক্ষয়ী হামলার পর যখন গাজায় যুদ্ধ শুরু হয়, তখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ছিল অন্ধকার। এরপর প্রায় দুই বছরে অন্তত ৫৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর প্রায় দুই তৃতীয়াংশই নারী ও শিশু। এই বিপুল হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে নেতানিয়াহু দেশের ভেতরে নজীরবিহীন শক্তিশালী অবস্থানে আসীন হয়েছেন।

গত শুক্রবার এ সংক্রান্ত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। বহু অপ্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে—কীভাবে নেতানিয়াহু যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে নিজের রাজনৈতিক পতন ঠেকিয়েছেন এবং ক্রমান্বয়ে আরও শক্তিশালী হয়েছেন।

এই অনুসন্ধানে নেতানিয়াহুর হাসপাতালের শয্যা থেকে শুরু করে ৭ অক্টোবরের হামলার পর তার বাসভবনের ভেতরের ঘটনা, ইসরায়েলি সামরিক সদরদপ্তর এবং ২০২৪ ও ২০২৫ সালজুড়ে চলা যুদ্ধবিরতির আলোচনা ও মন্ত্রিসভার বৈঠকের ভেতরের চিত্র তুলে আনা হয়েছে।

ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও আরব দেশগুলোর ১১০ জনেরও বেশি কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার এবং শখানেক সরকারি নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে—নেতানিয়াহুর বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে হামাসের পক্ষে ৭ অক্টোবরের হামলা চালানো সহজ হয়। সেসব পদক্ষেপ যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত ও প্রসারিত করতে সহায়তা করে। যদিও যুদ্ধ বিস্তৃত হওয়ায় অপ্রত্যাশিত ফল হিসেবে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহকে পরাজিত ও শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে দুর্বল করতে ইসরায়েলকে সাহায্য করেছে।

কিন্তু, গাজায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় হাজারো ফিলিস্তিনির মৃত্যু, অনাহার ও দুর্ভোগের সঙ্গে ইসরায়েলি জিম্মিদের মৃত্যুও ডেকে এনেছে। এতে বিচার এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন নেতানিয়াহু।

নিউইয়র্ক টাইমসের বিশদ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্তসার এখানে তুলে ধরা হলো

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যত মামলা

দুর্নীতির অভিযোগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আদালতে মামলা চলছে। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া এসব মামলায় তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, ঘুষ নেওয়া ও আস্থাভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। এক মামলার অভিযোগে আছে, তিনি হলিউড প্রযোজক আর্নন মিলচান থেকে বিলাসবহুল উপহার গ্রহণ করেছেন। ইসরায়েলি ধনকুবের ব্যবসায়ী-চলচ্চিত্র প্রযোজক ও সাবেক গুপ্তচর আর্নন মিলচান ১৩০টির বেশি চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত।

আরেক মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, তেল আবিব থেকে প্রকাশিত হিব্রু ভাষার পত্রিকা ইয়েদিয়োথ আহরনোথের সঙ্গে সুবিধাজনক সংবাদ কাভারেজের জন্য দেন-দরবার করেছেন নেতানিয়াহু। অপর মামলায় অভিযোগ—এক টেলিকম প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণমূলক সুবিধা দিয়ে নিজের পক্ষে সংবাদ প্রচার করিয়েছেন তিনি।

যদিও নেতানিয়াহুর পক্ষ থেকে এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা হয়েছে। কিন্তু মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যুদ্ধ চলতে থাকায় মামলাগুলোর কার্যক্রম বর্তমানে থেমে আছে।

হামাসের হামলা নিয়ে সতর্কবার্তা উপেক্ষা

৭ অক্টোবরের অনেক আগেই ইসরায়েলে সম্ভাব্য হামলা নিয়ে বারবার আসা সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেছিলেন নেতানিয়াহু। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে তিনি যখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তখন এক জ্যেষ্ঠ জেনারেল তাকে গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেখান। প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছিল, বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করার বিতর্কিত পরিকল্পনার কারণে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতাকে হামাস ও অন্য শত্রুরা সুযোগ হিসেবে দেখছে এবং হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

নেতানিয়াহু এই সতর্কবার্তাসহ অন্যান্য আরও সতর্কতা উপেক্ষা করেন। তার সরকার বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে খর্ব করে আইন পাস করলে ইসরায়েলে আরও অস্থিরতা তৈরি হয়। এর দুই দিন পরই হামাসের নেতারা ইসরায়েলের এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত হামলা এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

দায় চাপিয়ে নথি বদলের চেষ্টা

৭ অক্টোবর হামলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই নেতানিয়াহু নিজের দায় এড়াতে ছলনা শুরু করেন। সেদিন প্রথম দিকের এক ফোনালাপে তিনি বলেন, 'আমি তো গোয়েন্দা তথ্যে কিছুই দেখছি না।' এটি ছিল দায় এড়ানোর প্রথম চেষ্টা এবং এই ইঙ্গিত যে, তিনি হামলার ব্যর্থতার জন্য নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা প্রধানদের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করবেন।

যখন হামাসের হামলা চলছিল তখন নেতানিয়াহুর দল তাদের প্রভাবশালী সমর্থকদের বোঝাতে শুরু করে যে, এই ব্যর্থতার জন্য সেনা কর্মকর্তারাই দায়ী। একই সঙ্গে বৈঠকের কথোপকথনের রেকর্ডিং ফাঁস হওয়া বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়াও, সেনাপ্রধান হারজি হালেভিসহ জেনারেলদের শরীরে লুকানো মাইক্রোফোন আছে কি না, তা তল্লাশির ব্যবস্থা করা হয়।

যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে, নেতানিয়াহুর দল ৭ অক্টোবরের প্রথম দিকের ফোনালাপগুলোর সরকারি রেকর্ড পরিবর্তন করার জন্য আর্কাইভিস্টদের নির্দেশ দেয়।

যুদ্ধবিরতির আলোচনা ঝুলিয়ে রাখা

যুদ্ধের প্রথম দিকেই নেতানিয়াহু বিরোধীদলীয় নেতার কাছ থেকে ঐকমত্য সরকার গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি কট্টর ডানপন্থি জোটের সঙ্গেই থাকতে পছন্দ করেন। কারণ তারা যুদ্ধের পরেও তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে রাখার পক্ষে ছিল। এই সিদ্ধান্তের কারণে যুদ্ধের ব্যাপারে তাকে কট্টর ডানপন্থিদের কথা অনুযায়ী চলতে হয়েছে, বিশেষ করে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে।

যখনই যুদ্ধবিরতির আলোচনা গতি পেয়েছে, তখনই নেতানিয়াহুর কাছে এমন কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যা আগে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যেমন—গাজার দক্ষিণের রাফাহ দখল এবং পরে গাজা-মিসর সীমান্ত দখল।

ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তিতে অনীহা

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি করতে প্রস্তুত ছিল সৌদি আরব। কিন্তু, নেতানিয়াহু তাতে অনীহা দেখান।

২০২৪ সালের মে মাসে ওই আলোচনার সময় সৌদি নেতৃত্ব জানায়, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনে প্রস্তুত, যদি গাজা যুদ্ধ শেষ হয় এবং রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে ইসরায়েল।

নেতানিয়াহু ওই প্রস্তাবে অনাগ্রহ দেখানোয় যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। যুদ্ধবিরতির আলোচনা যখন থমকে যায়, তখন মার্কিন কর্মকর্তারা ইসরায়েলের ভেতরের জনমতের কথা নেতানিয়াহুকে স্মরণ করিয়ে দেন। তখনকার জনমতে দেখা যায়, ইসরায়েলিরা যুদ্ধ শেষ করে জিম্মিদের মুক্তিতে বেশি সমর্থন করেন।

আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়া

গাজায় যুদ্ধের শুরুতে নেতানিয়াহু অপর প্রতিপক্ষ হিজবুল্লাহ ও ইরানের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়িয়ে চলেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের প্রায় এক বছর পর, কিছু গোয়েন্দা সাফল্যের ফলে ইসরায়েল হিজবুল্লাহর বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডারকে হত্যা করে। এতে উৎসাহিত হয়ে নেতানিয়াহু হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতাকে হত্যা এবং দক্ষিণ লেবাননে আক্রমণের নির্দেশ দেন। ওই হামলায় হিজবুল্লাহর অস্ত্রভান্ডারের বড় একটি অংশ ধ্বংস হয়।

এরপর ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি বড় অংশ ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল। এর ফলে ইরান বা হিজবুল্লাহ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারেনি। আসাদ পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলের আরেক পুরোনো শত্রুর পতন ঘটে।

তেহরান যখন অস্বাভাবিকভাবে দুর্বল, তখন নেতানিয়াহু ইরানে আক্রমণ চালান। এটি তার রাজনৈতিক জীবনের 'সেরা অধ্যায়' হয়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহু তার দলকে ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসেন।

ঘটনার পরিক্রমায় দেখা যাচ্ছে নেতানিয়াহু গত দুই বছর ধরে নানা টালবাহানা করে তার বিচার পেছানোর পাশাপাশি গাজা যুদ্ধ চলমান রেখেছেন শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর পদ ধরে রাখার জন্যই।

Comments

The Daily Star  | English

Is the govt backing the wrongdoers?

BNP acting Chairman Tarique Rahman yesterday questioned whether the government is being lenient on the killers of a scrap trader in front of Mitford hospital due to what he said its silent support for such incidents of mob violence.

7h ago