সিরিয়ায় ২ গোষ্ঠীর সংঘাতে নিহত ৮৯

সিরিয়ার সওয়েইদা প্রদেশে দুই গোষ্ঠীর সংঘাতে ৮৯ জন নিহতের পর সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর অসংখ্য সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। ছবি: এএফপি
সিরিয়ার সওয়েইদা প্রদেশে দুই গোষ্ঠীর সংঘাতে ৮৯ জন নিহতের পর সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর অসংখ্য সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। ছবি: এএফপি

সিরিয়ার দক্ষিণের  সওয়েইদা প্রদেশে টানা দুই দিন সুন্নি বেদুঈন ও দ্রুজ গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৮৯ জন নিহত হয়েছেন। 

আজ সোমবার এই তথ্য জানিয়েছে এএফপি।

অপরদিকে, ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা সওয়েইদা প্রদেশে 'বেশ কয়েকটি ট্যাংকে' হামলা চালিয়েছে। তবে এসব হামলায় কতগুলো ট্যাংক ধ্বংস হয়েছে বা কেউ হতাহত হয়েছে কী না, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানানো হয়নি।

এর আগে সিরিয়ার দ্রুজ সম্প্রদায়ের সদস্যদের সুরক্ষা দেওয়ার অঙ্গীকারের বিষয়টি জানিয়েছিল ইসরায়েল।

বিশ্লেষকদের মতে, দুই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর এই সংঘাত সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা'র জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।

গত ডিসেম্বরের দীর্ঘদিনের একনায়ক বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে আল-শারার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী গোষ্ঠী। 

সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় 'অবিলম্বে ও নিশ্চিতভাবে' চলমান সংঘাত বন্ধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে আছে বাড়তি সেনা মোতায়েন এবং বেসামরিক মানুষদের জন্য নিরাপদ করিডর তৈরি। 

রোববার দামেস্ক অভিমুখী মহাসড়কে বেদুঈন গোত্রের সশস্ত্র সদস্যরা একজন দ্রুজ গোত্রীয় সবজি বিক্রেতাকে অপহরণ করেন। এরপর প্রতিশোধমূলক পাল্টা অপহরণ শুরু হয়। সেখান থেকেই সংঘাতের সূত্রপাত। 

অপহরণের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা পরবর্তী মুক্তি পেলেও সওয়েইদা শহরের বাইরে আজ সোমবারও সংঘাত অব্যাহত ছিল। আশেপাশের গ্রামগুলোতে মর্টারের গোলার আঘাতে ১০-১৫ জন মানুষ আহত হয়েছেন। এই তথ্য নিশ্চিত করেছে সংবাদমাধ্যম সওয়েইদা ২৪। 

এএফপির প্রতিবেদক সরেজমিনে পরিদর্শনে যেয়ে সওয়েইদার সড়কগুলো জনশূন্য অবস্থায় দেখতে পান। নিহতদের শেষকৃত্যের সময় গোলাগুলির শব্দ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন বার্তা সংস্থাটির ফটোগ্রাফার।

সম্প্রতি আমিরাতের সঙ্গে সমুদ্র বন্দর নিয়ে একটি বিশেষ চুক্তিতে সই করেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা (মাঝে)। ছবি: এএফপি
সম্প্রতি আমিরাতের সঙ্গে সমুদ্র বন্দর নিয়ে একটি বিশেষ চুক্তিতে সই করেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা (মাঝে)। ছবি: এএফপি

সওয়েইদার বাসিন্দা আবি তাঈম (৫১) বলেন, 'আমরা ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম—আমাদের আশেপাশে এলোমেলোভাবে একের পর এক মর্টারের গোলা এসে পড়ছিল।' 

'সড়কে গাড়ি চলাচল স্থবির হয়ে পড়েছে এবং বেশিরভাগ দোকান বন্ধ রাখা হয়েছে'।

প্রদেশের পশ্চিম দিকের পল্লী অঞ্চলে সংঘাত ও মর্টার হামলায় আহত হয়ে বেশ কয়েকজন মানুষ হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন।

একটি স্থানীয় যুদ্ধ পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিয়েছে, দুই দিনের সংঘাতে নিহতের সংখ্যা ৮৯। তাদের মধ্যে ৪৬ জন দ্রুজ, চার জন বেসামরিক মানুষ, ১৮ জন বেদুঈন যোদ্ধা ও সাতজন সামরিক পোশাক পরিহিত অজ্ঞাত ব্যক্তি আছেন।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল আল-এখবারিয়াকে জানান, 'সওয়েইদার শান্তি রক্ষা অভিযানে' অংশ নিতে যেয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ছয় সদস্য নিহত হয়েছেন। 

এএফপির সংবাদদাতা সওয়েইদা সিটির শহরতলীতে যোদ্ধাদের বহনকারী গাড়ি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় সামরিক বহরকে যুদ্ধ কবলিত অঞ্চলের দিকে আগাতে দেখেন।

বেশ কয়েকজন সশস্ত্র ব্যক্তিকে বেসামরিক গাড়ি ও মোটরসাইকেল ব্যবহার করে একই দিকে আগাতে দেখেন তিনি। এ সময় আহত ব্যক্তিদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সগুলো দামেস্কের দিকে রওনা দেয়। 

দ্রুজ সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক নেতারা শান্তি প্রতিষ্ঠার ও দামেস্ককে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

সওয়েইদার দ্রুজ সম্প্রদায়ের তিন আধ্যাত্মিক নেতার অন্যতম শেখ হিকমত আল-হিজরি ওই প্রদেশে 'নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের' অনুপ্রবেশের নিন্দা জানান এবং 'আন্তর্জাতিক সুরক্ষার' দাবি জানান।

দীর্ঘদিনের সংঘাত

এর আগে এপ্রিল ও মে মাসে দামেস্ক-সওয়েইদার দ্রুজ অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে দ্রুজ যোদ্ধা ও সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘাতে ১০০ জনেরও বেশি নিহত হন।

জানা গেছে, আগের সংঘাতে সুন্নি বেদুঈনরা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে দ্রুজদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। 

মে মাসের শেষের দিকে সংঘাতের অবসান ঘটাতে স্থানীয় রাজনীতিক ও আধ্যাত্মিক নেতারা আলোচনার মাধ্যমে সওয়েইদার নিরাপত্তার ভার দ্রুজ যোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন।

তবে বেশ কয়েকটি এলাকায় সশস্ত্র বেদুঈনদের উপস্থিতি থেকে যায়।

রোববার সওয়েইদার গভর্নর মুস্তফা আল-বাকুর প্রদেশের নাগরিকদের 'ধৈর্য ধারণ করার' আহ্বান জানান। অপরদিকে দ্রুজ সম্প্রদায়ের নেতারা কর্তৃপক্ষকে সংঘাত নিরসনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

দ্রুজদের সঙ্গে ইসরায়েলের সংশ্লিষ্টতা

সওয়েইদা প্রদেশে দীর্ঘদিন ধরে বেদুঈন ও দ্রুজ গোত্রের মধ্যে মতবিরোধ চলছে, যা সময়ে সময়ে সংঘাতে রূপ নেয়। 

মার্চে এ অঞ্চলে আলাবি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। নিহত হন এক হাজার ৭০০ আলাবি। এরপরও থামেনি সংঘাত। দ্রুজ অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে একের পর এক হামলা হতে থাকে।

বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনায় আল-শারার নেতৃত্বাধীন সিরিয়ার নতুন প্রশাসনের এ ধরণের সাম্প্রদায়িক বা গোষ্ঠীভিত্তিক সংঘাতে রাশ টেনে ধরার সক্ষমতা নিয়ে আস্থার অভাব দেখা দিয়েছে। 

এসব গোলযোগের মাঝে ইসরায়েল দ্রুজ সম্প্রদায়কে সুরক্ষা দেওয়ার অজুহাত দেখিয়ে বেশ কয়েক দফা হামলা চালিয়েছে। মে মাসে দামেস্কে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের কাছে এক দফা হামলা চালায় নেতানিয়াহুর ইসরায়েল।

উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সাল থেকে সিরিয়ার গোলান মালভূমির অংশবিশেষ দখল করে রেখেছে ইসরায়েল, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ একটি উদ্যোগ।

ইসরায়েলে দ্রুজ সম্প্রদায়ের এক লাখ ৫২ হাজার সদস্য বসবাস করেন। তাদের মধ্যে ২৪ হাজার মানুষ ইসরায়েল অধ্যুষিত গোলানে বসবাস করেন। তবে তাদের মধ্যে পাঁচ শতাংশেরও কম মানুষ ইসরায়েলের নাগরিক।  

Comments