ইরান হামলায় ইসরায়েলকে আকাশপথে কেন বাধা দেয়নি সিরিয়া

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। ফাইল ছবি: এএফপি
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। ফাইল ছবি: এএফপি

ইরানের বিরুদ্ধে ১২ দিনের সামরিক অভিযানে অসংখ্যবার সিরিয়ার আকাশসীমা দিয়ে উড়েছে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। কিন্তু নিজ দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের এই ঘটনায় ভ্রুক্ষেপও করেননি সিরিয়ার নেতা আহমেদ আল-শারা। দেননি কোনো বাধা।

হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমাতজিয়া বারাম এক সাক্ষাৎকারে যুক্তি দেন, ইসরায়েলকে যথেচ্ছা হামলার সুযোগ দেওয়ায় সিরিয়ার নবগঠিত সরকারের উপকার হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার এই তথ্য জানিয়েছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম দ্য জেরুজালেম পোস্ট।

আমাতজিয়া'র সাক্ষাৎকারটি হিব্রু ভাষার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম মারিভে প্রকাশিত হয়েছে।

ইসরায়েলকে বাধা দিয়ে সিরিয়ার 'স্বার্থসিদ্ধি' হতো না

সৌদি যুবরাজ বিন সালমান ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে সিরিয়ার আল-শারা। ফাইল ছবি: রয়টার্স
সৌদি যুবরাজ বিন সালমান ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে সিরিয়ার আল-শারা। ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে তেহরান। একইসময়ে, সিরিয়ার অন্তবর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা ও তার কার্যালয়ও পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখে।

ইসরায়েলকে বিনা বাধায় সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেওয়ার সিদ্ধান্তের নেপথ্যে সিরিয়ার নেতা যে বিষয়গুলোকে আমলে নিয়েছিলেন, এর মধ্যেই অন্তর্নিহিত আছে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত স্থিতিশীল রাখার চাবিকাঠি—এমন দাবি করেন বারাম।

আমাতজিয়া বারাম আরও বলেন, 'আমি যদি আল-শারা'র জায়গায় থাকতাম, তাহলে আমার দেশের নাগরিকদের বলতাম যে ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর কার্যক্রমকে ঝামেলাপূর্ণ করার সক্ষমতা থাকলেও এ ধরনের উদ্যোগে আমার কোনো স্বার্থ জড়িত নেই।'

নব্য সিরীয় চিন্তাধারা

আকাশ হামলা অভিযানে ইসরায়েলি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। ফাইল ছবি: রয়টার্স
আকাশ হামলা অভিযানে ইসরায়েলি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। ফাইল ছবি: রয়টার্স

এই বিশ্লেষক আল-শারার এই চিন্তাধারাকে 'নব্য সিরীয় চিন্তাধারা' বলে অভিহিত করে বলেন, 'আমি সিরিয়ার নেতা হলে আরও বলতাম—ইসরায়েলিরা ইরানের বিরুদ্ধে যত হামলা চালাবে, ততই আমার স্বার্থ সিদ্ধি হবে।'

এ ক্ষেত্রে সিরিয়ার স্বার্থ খুবই স্পষ্ট। কৌশলগত দিক দিয়ে এ অঞ্চলে দামেস্কের নতুন শাসকদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান।

'ইরানকে দুর্বল করে এমন যেকোনো হামলা আল-শারা'র সরকারের জন্য উপকারী', যোগ করেন বারাম।

আমাতজিয়া বারাম ব্যাখ্যা দেন, মূলত এ কারণেই ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও সে পথে পা দেয়নি সিরিয়া।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের ২ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা

ইসরায়েলের উপকূলীয় শহর নেতানিয়ার আকাশে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র। তবে এই হামলা যুদ্ধবিরতির আগে হয়েছে না পরে হয়েছে, তা জানা যায়নি। ছবি: এএফপি/২৪ জুন ২০২৫
ইসরায়েলের উপকূলীয় শহর নেতানিয়ার আকাশে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র। তবে এই হামলা যুদ্ধবিরতির আগে হয়েছে না পরে হয়েছে, তা জানা যায়নি। ছবি: এএফপি/২৪ জুন ২০২৫

এই ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি ছাড়াও ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযান থেকে দেশটি সম্পর্কে আল-শারা দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছেন।

প্রথমত, ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর কার্যক্রমের পরিধি সম্পর্কে তিনি ধারণা পেয়েছেন।

দ্বিতীয় শিক্ষা হলো—ইসরায়েলের গোয়েন্দা ও গুপ্তচরদের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা। এই অভিযান বিশ্বকে দেখিয়েছে, কীভাবে ইসরায়েল শত্রু দেশের ভূখণ্ডের গভীরে গিয়ে নিখুঁত হামলা পরিচালনা করতে পারে।

'দুই-তিন দিনের মধ্যেই ইরানের জ্যেষ্ঠ সামরিক নেতৃবৃন্দকে নির্মূল করে ইসরায়েল। তারপর তাদের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাটিগুলোয় হামলা চালায়। এসব ঘটনা থেকে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার অর্জনের গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

এসব নিখুঁত অভিযানকে 'ঈর্ষণীয়' সাফল্য হিসেবে আখ্যা দিয়ে আমাতজিয়া বারাম বলেন, 'ইসরায়েল প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরের ভবনগুলোয় সরাসরি হামলা চালিয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে।'

তার মতে, 'এতে সন্দেহ নেই, আল-শারা তার সামরিক পোশাকের বাম পকেটে যে নোটবুক রাখেন, সেখানে এই বিষয়গুলো টুকে রেখেছেন।'

স্পষ্ট ও উদ্বেগজনক উপসংহার

সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালাতে কাঁধে রকেট বহন করছেন এক বিদ্রোহী। ছবি: এএফপি
সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালাতে কাঁধে রকেট বহন করছেন এক বিদ্রোহী। ছবি: এএফপি

আমাতজিয়া বারামের মতে—এসব ঘটনা থেকে আল-শারা, তথা সিরিয়া যে উপসংহার টেনেছে, তা স্পষ্টতই উদ্বেগজনক।

'আমার ভুল হতে পারে, বা আমার অতটা সক্ষমতা নাও থাকতে পারে, কিন্তু আমি আল-শারা হলে এটাই ধরে নিতাম যে ইসরায়েল চাইলেই যেকোনো সময় আমার কাছে পৌঁছাতে পারে।'

'আল-শারা বুঝে নিয়েছে, আত্মহত্যার ইচ্ছা না থাকলে ইসরায়েলিদের সঙ্গে বিবাদে না জড়ানোই ভালো,' যোগ করেন তিনি।

তবে শুধু ইসরায়েল-ভীতি নয়, অন্যান্য কারণেও দেশটিকে ঘাটাতে চাননি আল-শারা—এমন মতও দেন বিশ্লেষক আমাতজিয়া বারাম।

তিনি আরও বলেন, 'আল-শারা ফিলিস্তিনি নন। তিনি যেটাকে নিজের ঐতিহাসিক জন্মভূমি হিসেবে দেখেন, সেটার কোনো অংশ আমরা দখল করিনি। আমরা (হাফেজ-আল) আসাদের কাছ থেকে গোলান মালভূমি কেড়ে নিয়েছি, কিন্তু নতুন করে কোনো রক্তাক্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনা নয় সেটি।'

'এমনকি, হাফেজ আল-আসাদ ও তার ছেলে বাশার আল-আসাদ, দুইজনই কার্যত মেনে নিয়েছিলেন যে আমরাই (ইসরায়েল) গোলান মালভূমির প্রকৃত মালিক। এ কারণেই তারা ১৯৭৩ সালের পর আর গোলানের দখল ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি। সিরিয়ার সব মানুষ এটা জানে। অন্যভাবে বলতে গেলে, গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটাই চলে আসছে যে, সিরিয়ার শাসকরা গোলানের ওপর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ মেনে নিয়েছে।'

গোলান মালভূমির নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নিতে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সিরিয়ার জাতীয়তাবাদী ও জিহাদপন্থিরা আল-শারার ওপর যতই চাপ দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, এই উদ্যোগ হালে পানি পাবে না বলেও মনে করেন বিশ্লেষক আমাতজিয়া বারাম।

ইসরায়েলের প্রতি আল-শারার কৃতজ্ঞতা

হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করছে ইসরায়েলি জেট বিমান। ফাইল ছবি: রয়টার্স
হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করছে ইসরায়েলি জেট বিমান। ফাইল ছবি: রয়টার্স

আমাতজিয়া বারামের মতে—ইসরায়েল যা করেছে, তার জন্য আল-শারা কৃতজ্ঞ। তাকে সরিয়ে দিয়ে সিরিয়ায় নিজেদের প্রভাব ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে ইরান। 'আল শারা নিজেও তা জানেন, আর এটাও বুঝেন যে এখন তা করা তাদের জন্য অনেক ঝামেলাপূর্ণ। পাশাপাশি, ইসরায়েলি অভিযান আল-শারাকে এটাই দেখিয়েছে যে, সিরিয়ার দুই চিরশত্রুকে—ইরাকের শিয়া আধা-সামরিক বাহিনী ও হিজবুল্লাহ—উভয়কেই তেল আবিব কার্যকরভাবে দমন করতে পারে।

সংকটের সময় সহায়তার উদ্দেশ্যেই মূলত হিজবুল্লাহ ও ইরাকের আধা-সামরিক শিয়া বাহিনীকে গড়ে তুলেছিল তেহরান। কিন্তু ১২ দিনের যুদ্ধে ওই দুই বাহিনীর উপস্থিতি দেখা যায়নি।

ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা ধ্বংস করা এবং ইরান ও মিত্রদের ভবিষ্যৎ হামলা থেকে বিরত রাখা। কিন্তু কার্যত, এসব লক্ষ্য কতটা পূরণ হয়েছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও, এতে সন্দেহ নেই যে সিরিয়ার নতুন শাসকদের অবস্থান আগের তুলনায় আরও শক্তিশালী হয়েছে। পাশাপাশি, ইসরায়েল ও আল-শারা'র সিরিয়ার মধ্যে সহযোগিতার পথও খুলেছে।

আমাতজিয়া বারাম দাবি করেন, এতে আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াইয়ে কিছুটা হলেও ভারসাম্য এসেছে। আগামী বছরগুলোয় এই পরিবর্তনের হাওয়া মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

Comments