চীনের সামরিক কুচকাওয়াজ কী বার্তা দিচ্ছে

জুনের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কুচকাওয়াজ আয়োজনের দুই মাসের একটু বেশি সময় পর বিশ্বের আরেক পরাশক্তি চীন এবার আয়োজন করতে যাচ্ছে সামরিক প্যারেড। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৭৯তম জন্মদিন উপলক্ষে ওয়াশিংটনে আয়োজিত সেই 'ফিকে' কুচকাওয়াজের বিপরীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০তম বর্ষপূর্তিতে চীনের আয়োজন জমকালো।
রাজধানী বেইজিংয়ে বুধবারের সেই বিশাল আয়োজন কেবল অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, বরং এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বেইজিংয়ের তিয়ানানমেন স্কয়ারের এই কুচকাওয়াজ চীনের ক্ষমতা ও কূটনৈতিক প্রভাবের এক বড় প্রদর্শনী, যা পশ্চিমা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে নতুনভাবে সাজানোরই অংশ।
কুচকাওয়াজে চীনের নেতা শি জিনপিংয়ের পাশে থাকবেন রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান এবং মিয়ানমারের মতো দেশগুলোর নেতারা। যাদের অনেকের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চার নেতার উপস্থিতি একটি 'চতুর্ভুজ জোট' গঠন করতে পারে যাকে পশ্চিমা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা 'অস্থিরতার অক্ষ' বা 'অ্যাক্সিস অব আপহিভ্যাল' বলে অভিহিত করছেন।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, মোট ২৬টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবেন। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বাণিজ্য আলোচনার মধ্যে বেইজিংয়ের সামরিক ও কূটনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে কুচকাওয়াজকে।
যারা থাকছেন
সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন সম্মেলনে যোগ দিয়ে এরই মধ্যে চীনে অবস্থান করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মঙ্গলবার বেইজিংয়ে চীনা নেতা শির সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি শিকে 'প্রিয় বন্ধু' বলে সম্বোধন করেছেন। এ সময় তারা দুই পরাশক্তির মধ্যে সম্পর্কের জন্য তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রশংসা করেন।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সামরিক এই কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে প্রথমবারের মতো এই দুই নেতা শি জিনপিংয়ের পাশে প্রকাশ্যে উপস্থিত হবেন। আশা করা হচ্ছে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানও এই আয়োজনে যোগ দেবেন।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং, যিনি খুব কমই বিদেশ ভ্রমণ করেন, তিনিও এই প্যারেডে যোগ দেবেন।
তবে বেশিরভাগ পশ্চিমা নেতাই এই প্যারেড বর্জন করবেন। এর ফলে এই আয়োজনটি চীন, রাশিয়া এবং গ্লোবাল সাউথের মধ্যে কূটনৈতিক সংহতির বড় আয়োজনে পরিণত হবে।
বেইজিংয়ের এই অনুষ্ঠানে যে দুজন পশ্চিমা রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান উপস্থিত থাকছেন, তারা হলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্র স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো এবং সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্ডার ভুসিক।
ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরোধী ছিলেন ফিকো এবং মস্কো সফর করে ইইউর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। অন্যদিকে ভুসিচ মে মাসে মস্কো সফর করেছেন এবং রাশিয়া ও চীনের সাথে সুসম্পর্ক চান বলে জানিয়েছেন। যদিও বলেছেন যে সার্বিয়া ইইউতে যোগদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কুচকাওয়াজে জাতিসংঘের প্রতিনিধিত্ব করবেন আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল লি জুনহুয়া, যিনি এর আগে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। যার মধ্যে ইতালি, সান মারিনো এবং মায়ানমারে চীনা রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্যারেডে কী দেখা যাবে
চীনের অন্যতম বৃহৎ ও সুপরিকল্পিত এই অনুষ্ঠানে অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম যেমন যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং হাইপারসনিক অস্ত্রের প্রদর্শনী করা হবে।
এছাড়াও চীন বেশ কিছু নতুন অস্ত্র প্রদর্শন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ডিএফ-২৬ মধ্যম-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এটি প্রচলিত বা পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঘাঁটিতে আঘাত হানতে সক্ষম দাবি করে চীনা গণমাধ্যম এটিকে 'গুয়াম কিলার' বলে আখ্যা দিয়েছে।
চীনা ভাষায় 'ঈগল অ্যাটাক' নামে পরিচিত নতুন জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র 'ইং জি' প্রদর্শিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করা থেকে বিরত রাখতে এটি ডিজাইন করা হয়েছে বলছে চীন।
কুচকাওয়াজের আগে চীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের একটি 'সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি' তুলে ধরার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে। পিপলস ডেইলির এক মন্তব্যে বলা হয়েছে, ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চীনের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং হেয় করা হয়েছে। এই কুচকাওয়াজ তাই ইতিহাসকে পুনরায় নিজেদের মতো করে তুলে ধরার একটি সুযোগ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সামরিক কুচকাওয়াজ শি জিনপিংয়ের প্রভাব তুলে ধরার জন্য তৈরি করা হয়েছে। শি পশ্চিমা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে নতুনভাবে সাজাতে আগ্রহী।
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অন এশিয়ার গবেষক লিম চুয়ান-টিওং বলেন, এই সাময়িক প্রদর্শনীর প্রধান উদ্দেশ্য হলো শি-এর ক্ষমতা এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিকে আরও দৃঢ় করা।
লিম বলেন, 'উপস্থিত নেতাদের বেশিরভাগই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উদযাপনে চীনকে সমর্থন করতে আসছে না। তারা আসছে চীনকে সমর্থন জানাতে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এড়াতে। এটা খুব সহজ।'
কুচকাওয়াজের আগে, বিশ্ব নেতারা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) নিরাপত্তা ফোরামে যোগ দিয়েছেন। ভ্লাদিমির পুতিনের পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়াও উপস্থিত ছিলেন।
মোদির এই সফর ছিল গত সাত বছরের মধ্যে তার প্রথম সফর, যা এমন এক সময়ে হলো যখন ওয়াশিংটনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। এর কয়েক দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় রপ্তানির ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ করেছে। এর কারণ হিসেবে তারা দিল্লির রুশ তেল কেনা বন্ধ না করার কথা উল্লেখ করেছে।
দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, চীনের জন্য রোববার শুরু হওয়া দুই দিনের এসসিও শীর্ষ সম্মেলনটি এর চেয়ে ভালো সময়ে হতে পারত না। মোদি এমন এক সময়ে চীনে থাকবেন যখন ভারত-চীন সম্পর্ক স্থিতিশীল হচ্ছে এবং ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি নিশ্চিত নই যে মার্কিন কর্মকর্তারা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছেন কিনা যে তারা এত অল্প সময়ে কতটা বিশ্বাস নষ্ট করেছেন।'
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষক সাইমন ওয়েজেম্যান বলেন, বুধবারের এই বিশাল আয়োজন চীনের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতস্থানে লবণ দেওয়ার মতো। এর মাধ্যমে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে চাইছে, 'যদি তোমরা কুচকাওয়াজ করো, তাহলে আমরা তা সবার চেয়ে ভালোভাবে করতে পারি।'
সব মিলিয়ে, এই কুচকাওয়াজ একটি নিছক সামরিক প্রদর্শনী নয়, বরং বর্তমান বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির জটিল প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের একটি সুস্পষ্ট বার্তা।
Comments