বনসাই: ক্ষুদ্র গাছের প্রাচীন ইতিহাস

বনসাই গাছের সঙ্গে জাপানের একটি দৃঢ় সম্পর্কে আছে। তবে অনেকেই জানেন না ক্ষুদ্রাকৃতির গাছ শিল্পটির জন্ম প্রাচীন চীনে।
বনসাই ছবি: সংগৃহীত

বনসাই গাছের সঙ্গে জাপানের একটি দৃঢ় সম্পর্কে আছে। তবে অনেকেই জানেন না ক্ষুদ্রাকৃতির গাছ শিল্পটির জন্ম প্রাচীন চীনে।

সপ্তম খ্রিস্টাব্দে, চীনারা পাত্রে বামন গাছ জন্মানোর জন্য বিশেষ কৌশল ব্যবহার করছিল। এই কাজটি 'পুন-সাই' (পেনজাই) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। মূলত সমাজের উচ্চবিত্তরাই এটি চাষ শুরু করে। তবে এর প্রসার লাভ করে জাপানে। বিশ্বের প্রকৃতি প্রেমীরা শিল্পের জীবন্ত কাজ হিসেবে বনসাইকে বেছে নিয়েছে।

বনসাই অর্থ

বনসাই একটি জাপানি শব্দ, যার অর্থ 'পাত্রের মধ্যে গাছ'। শব্দটি মূলত চীনা শব্দ 'পুন-সাই' বা 'পেনজিং' থেকে এসেছে। চীনা ভাষায়, 'কলম' মানে পাত্র এবং 'জিং' মানে দৃশ্য বা ল্যান্ডস্কেপ।

বনসাই গাছগুলো প্রকৃতির একটি ক্ষুদ্রাকৃতির উপস্থাপনা করার উদ্দেশ্যে করা হয়। বিশাল বৃক্ষ শ্রেণীর গাছকে বিশেষ পদ্ধতিতে পাত্রে পালন করাটাই বনসাই শিল্পের জন্ম।

বনসাই গাছ কিসের প্রতীক

আজ থেকে ১ হাজার ৩০০ বছরেরও বেশি আগে যখন বনসাই গাছ প্রথম চীনে চালু হয়েছিল, তখন তাদের সমাজের উচ্চবিত্তদের মধ্যে একটি সামাজিক মর্যাদা হিসেবে দেখা হত। আজ বনসাই গাছ সারা বিশ্বের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। জাপানে বনসাই গাছকে সম্প্রীতি, ভারসাম্য, ধৈর্য এমনকি ভাগ্যের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়। অপরদিকে বৌদ্ধ ধর্মের বিশ্বাস-'বনসাই ধ্যান বা চিন্তার একটি বস্তু'।

চীনে বনসাইয়ের ইতিহাস

আমরা প্রাচীন যে ক'টি শিল্প দেখতে পাই তার বেশির ভাগের জন্ম চীনে। আর যে দেশের মানুষের ফুল আর উদ্যানের প্রতি বরাবর দুর্বলতা, সে দেশে বনসাইয়ের মত একটা শিল্পের আবিষ্কার কাকতালীয় কিছু নয়। বনসাইয়ের আবির্ভাব নিয়ে অনেক চমকপ্রদ কিছু ধারণা আছে চীনাদের মধ্যে।

চীনা ভ্রমণকারীরা পাহাড়ের চূড়ায় যখন ভ্রমণ করতো তখন তারা দেখতে পেত বড় গাছের আকৃতির মত ছোট ছোট গাছ। মূলত প্রাকৃতিক জলবায়ুর কারণেই সেই গাছগুলোর আকৃতি হয়ে গিয়েছিল ছোট। এতটাই ছোট যে চাইলেই সেগুলো নিয়ে আসা যেত। আবার ধারণা করা হয় গাছগুলো মূল্যবান হওয়াতে চীনারা গাছগুলোকে ছোট করে নিয়ে আসত সমভূমিতে।

অপরদিকে চীনের 'তাও' ধর্মাবলম্বীরা মনে করতেন, যদি মানুষের হাত দিয়ে বৃহদাকার গাছের অতিক্ষুদ্র প্রতিরূপ তৈরি করা যায়, তাতে এর মধ্যে একধরনের অতিপ্রাকৃতিক শক্তি এসে জমা হবে।

চৈনিকদের সেই প্রাচীনকাল থেকে 'মিনিয়েচার' বা কোনো বৃহদাকার জিনিসকে ছোট আকার দেওয়ার প্রতি একধরনের মুগ্ধতা ছিল। এরকম সৃজনশীল শিল্পের দেখা মেলে চীনেই। তারা যে বনসাইয়ের প্রতি সবার আগে আকৃষ্ট হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া প্রায় ২ হাজার ৩০০ বছরেরও বেশি আগে 'ফাইভ এজেন্ট থিওরি' (পানি, আগুন, কাঠ, ধাতু ও মাটি) থেকে উৎসাহিত হয়ে প্রকৃতির এমন বামন রূপ তৈরির এই বুদ্ধি চীনাদের মাথায় আসে বলেও অনেকের ধারণা।

জাপানে বনসাইয়ের ইতিহাস

বনসাই গাছের চীন থেকে জাপান যাত্রা পুরোপুরিই ধর্মীয় কারণে। ধারণা করা হয় প্রায় ১ হাজার ২০০ বছর আগে 'হান' রাজবংশের শাসনামলে চীনা সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুরা জাপানে যাত্রা করেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। সেই সময় তারা নিজেদের সঙ্গে পবিত্র উপহার হিসেবে ছোট ছোট বনসাই গাছ নিয়ে যান। জাপানিরা বরাবরই চীনাদের গুণমুগ্ধ ছিল, এবারেও তার ব্যতিক্রম হলো না। তারা দ্রুত বনসাই বানানোর কায়দা-কানুন শিখে ফেলে এবং এইটাকে কীভাবে আরো সৃজনশীল করা যায় তার চেষ্টা করতে থাকে।

সময়ের সঙ্গে জাপানে বনসাইকে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ভাবা হতে লাগলো। বনসাই নিয়ে জাপানি বিভিন্ন লোকগাথাও আছে। এর মাঝে খুব পরিচিত একটি গল্প সামুরাই যোদ্ধাকে নিয়ে। তার সংগ্রহের সর্বশেষ ৩টি বনসাই গাছকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে একজন শীতার্ত ভিক্ষুকে একটু উষ্ণতা দেবার জন্যে। এই লোকগাথাটি নিয়ে পরবর্তীতে মঞ্চ নাটকে রূপান্তর দেয়াও হয়, আঁকা হয় অনেক শিল্পকর্মও।

মধ্যযুগের দিকে জাপানিজদের মাঝে বনসাই বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেল। ফলস্বরূপ, বনসাই শিল্পীদের কদর রাতারাতি বেড়ে গেল সেখানে। অনেকে নিজেরাই বনসাই তৈরি করতে লাগলো ঘরে বসেই। এদেশে নারীদের সুচিকর্ম যেমন বিশেষ গুন, তেমনি জাপানে যে নারী বনসাই করতে পারতেন তাদের সেটি বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হত। আবার অনেকেই নিজেদের সংগ্রহের বনসাই দিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজনও করত।

সতেরশ শতকের দিকে এর প্রচার বাড়তে থাকে। তবে ১৮০৬ সালের দিকে ইংল্যান্ডের রানী শার্লট উপহার হিসেবে জাপানের তরফ থেকে সুন্দর একটি বনসাই গাছ পান। এভাবেই জাপানিদের বনসাই ধীরে ধীরে বাকি দুনিয়াতে ছড়িয়ে গেল।

বাংলাদেশে বনসাই

বাংলাদেশও বনসাই বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। গড়ে উঠেছে 'বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি'। প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদক মো. আনিসুল হক জানান, প্রতিবছর বনসাই প্রশিক্ষণের আয়োজন করি আমরা। বাংলাদেশে এটি ইনডোর প্ল্যান্ট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

Comments