জিমে কেন যাচ্ছেন

করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত নিয়মিত জিমে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের দেশে তেমনভাবে প্রচলিত ছিল না। তবে, স্বাস্থ্য সচেতন অনেকেই এখন জিমে যান।
জিমে ভর্তি হওয়া কোনো খারাপ বিষয় নয়। তবুও একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, তাহলো- সবাই কি সঠিক কারণে জিমে ভর্তি হচ্ছেন, না আবার কোনো কারণ ছাড়াই জিমে যাচ্ছেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করার আগে আমাদেরকে প্রথমে 'সঠিক কারণ' বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করে নিতে হবে। নিরপেক্ষভাবে যদি বলি সাধারণত মানুষ জিমে ভর্তি হয় মূলত বিভিন্ন রকমের স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য। কেননা জিমে শরীরচর্চার মাধ্যমে শরীরে নানা ধরণের সমস্যার উপশম হয়। এগুলোই জিমে ভর্তি হবার সঠিক কারণ হতে পারে।
কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা বলে জিমে যাওয়ার বিভিন্ন কারণ জানান যায়। বেশিরভাগ তরুণের ক্ষেত্রেই জিমে যুক্ত হওয়ার প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে 'বডি ডিজমোর্ফিয়া'।
১৭ বছরের কিশোর নাফিস আবরার ইসলাম বলেন, দেহের কাঠামোর জন্য আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। আমার দেহের কাঠামো আমার নিজের সম্পর্কে সংকোচ বাড়িয়ে তোলে। আমার শারীরিক গঠনের কারণে যেকোনো সামাজিকতায় আমি অনেক বেশি হতাশ, ভয় ও দুশ্চিন্তার মধ্য থাকি। মানুষ আমাকে দেখে কী ভাববে সেটাই সারাক্ষণ ভাবতাম আমি। সেখান থেকেই মূলত আমি জিমে ভর্তি হই। আমার মনে হয় ওয়ার্কআউট করলে আমি নিজেকে এই সংকোচ থেকে বাঁচাতে পারবো।'
একটি আদর্শ শরীর কাঠামো পেতে ও আকর্ষণীয় হতে মানুষ যে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করেন সেই বিষয়টি একেবারেই নতুন নয়। এই ইচ্ছে আরও বেশি থাকে কম বয়সী তরুণদের মধ্যে। অনেক সময় অবচেতন মনে অনেক শিক্ষিত প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষও নিজেদের শরীর কেমন দেখাচ্ছে সেটা নিয়ে ভাবেন। এই ভাবনাগুলো আরও বেশি প্রভাবিত হতে থাকে যখন আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লম্বা, চিকন ও আদর্শ ম্যাসলম্যানদের দেখি।
কিশোর প্রথম মিত্রা বলেন, আমার নিউজফিডের একটি বড় অংশ জুড়ে বডিবিল্ডার এবং সব ইনফ্লুয়েন্সারদের ভিডিও ও ছবি। সেখানে দেখা যায় তাদের আকর্ষণীয় সব শরীরী কাঠামো। এইসব বিষয় আমার নিজের দেহ কাঠামো নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত করে তোলে। সেই সঙ্গে আমার মধ্যে একপ্রকার ধারণার জন্ম দেয় যে, বাহ্যিক কাঠামোর ভিত্তিতেই কোনো ব্যক্তিকে বাস্তবে মূল্যায়ন করা হয়।
শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই নয় অনেকে তাদের পারিপার্শ্বিক চাপেও জিমে যুক্ত হয়ে থাকেন। এক বন্ধু এসে আরেক বন্ধুকে তার নিজের অভিজ্ঞতা জানায় ও প্রভাবিত করে। এভাবেই একটি বড় দল বানিয়ে জিমে যুক্ত হওয়ার ঘটনা দেখা যায়। অনেকে কেবল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ভয়েই জিমে যুক্ত হয়ে থাকেন।
আবদুল্লাহ বিন হাসেমের অভিজ্ঞতাই অনেকটা সেরকমই। তিনি বলেন, 'আমার বেশিরভাগ বন্ধুই আমার আগেই জিমে ভর্তি হয়। তারা নিয়মিত আমাকে তাদের সঙ্গে জিমে যাবার জন্য বলতে থাকে। আমার নিজের তেমন ইচ্ছে ছিল না। তবে ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে ও একত্রে থাকার ইচ্ছেতেই আমাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।'
ওয়ার্কআউট করা একটি কঠিন প্রক্রিয়া। যেখানে প্রয়োজন সময়, পরিশ্রম এবং নিয়মিত কিছু করতে পারার দৃঢ়তা। তাই সোশ্যাল মিডিয়ার এডিট করা ছবি কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে সময়কাটাতে জিমে ভর্তি হবার জন্য জিমে জয়েন করা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে যেসব ইনফ্লুয়েন্সারদের দেখা যায়, তারা কেবল তাদের ফলাফল পাওয়ার পরেই সেগুলো আপলোড করে থাকেন। তারা তাদের আকর্ষণীয় দেহ পেতে কী পরিমাণ শ্রম করেছেন সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেন না। তাদের এই আকর্ষণীয় কাঠামোর পেছনে রয়েছে সঠিক খাদ্য পরিকল্পনা ও অভিজ্ঞদের পরামর্শ। সেগুলো না ভেবে অনেকেই স্বল্প সময়ে তাদের মতো দেহ কাঠামো পেতে উঠে পরে জিমে যুক্ত হতে থাকেন।
এইসব ভুল ধারণার জন্য লাভের চেয়ে বরং ক্ষতি হয় বেশি। এক দুজন হয়তো ভাগ্যগুণে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেয়েও যেতে পারেন। তবে বেশিরভাগই তাদের নিজেদের দেহের সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত চাপ নেওয়ার কারণে সহজেই হার মেনে নেন। তাদের পক্ষে বেশিদিন এই জিমে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না।
তাই নিজের দেহ নিয়ে যে হতাশা ছিল তা আরও বেশি বেড়ে যায়। মনে হবে যে, আপনি যাই করেন না কেন, আপনার পক্ষে এই কাঙ্ক্ষিত দেহ কাঠামো পাওয়া সম্ভব নয়। আবার যদি বন্ধুদের চাপে যুক্ত হন, তাহলেও এই অতিরিক্ত চাপ নেওয়ার কারণে দেখা দিবে পেশি ব্যথা, ক্লান্তি ও অবসাদ।
আরও এক দল মানুষ আছেন, যারা কিছুদিন চেষ্টা করেই তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যান। তারা সেই ফল পাওয়ার পরে ধীরে ধীরে জিমে যাওয়া বন্ধ করে দেন এবং স্বল্প সময়ে তাদের শরীর পূর্বের কাঠামোতে ফিরে যেতে থাকে। তারা দেখে যে, কয়েকদিনের মধ্যেই তারা আগের অবস্থানে ফিরে গেছেন। এই বিষয়টি তাদেরকে আরও বেশি অনুপ্রেরণাহীন করে তোলে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী খালিদ আহমেদ এমনটাই জানান তিনি জানান, ২ মাসের মধ্যেই জিমে যাওয়া বন্ধ করে দেন। কিছু সময় অতিরিক্ত ওয়ার্কআউট করার পরে তার দেহে আর কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। ফলে তিনি অনেক বেশি হতাশ হন। তিনি ভাবেন, কম সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া তার জন্য ঠিক হয়নি।
অনেকেই ভাবে জিমে ভর্তি হয়ে কঠোর পরিশ্রম করলেই হয়তো মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত দেহ কাঠামো পেয়ে যাবে। কিন্তু, বাস্তবে সেটি হয় না। জেনেটিক্স মানুষের দেহের কাঠামো নির্ধারণের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী। অনেকে হয়তো জিমে না গিয়েও সুন্দর দেহের অধিকারী হতে পারেন। কিন্তু তার জন্য দরকার দীর্ঘ সময় ও নিয়মিত প্রচেষ্টা।
কাউকে জিমে যেতে অনাগ্রহী করতে এই লেখা নয়। কেউ যেন বাহ্যিক কোনো চাপের শিকার হয়ে জিমে গিয়ে নিজের ক্ষতি না করেন সেটিই মূল উদ্দেশ্য। জিমে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত হতে হবে একান্তই আপনার নিজের। নিজের সুস্থতা ও নিয়মিত অল্প অল্প করে নিজের পরিবর্তন হবে ভেবেই সেখানে সময় দেওয়া প্রয়োজন। এজন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও একটি পরিমিত খাদ্য কাঠামোর। তাহলেই কেবল স্বাভাবিক ভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবেন।
অনুবাদ করেছেন আরউইন আহমেদ মিতু
Comments