গুলশানে স্ট্রিট ফুডের সন্ধান
গুলশান-২ নম্বরের ঠিক প্রাণকেন্দ্রে, বড় আর ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁগুলো থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে অনেকটা জাদুকরি জায়গার সন্ধান দেব আজ। এমন একটি জায়গা, প্রথমবার যা দেখে রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছিলাম আমি আর সহকর্মী অর্কিড চাকমা।
আপনারা হয়তো এ কথা শুনে অবাক হচ্ছেন। গুলশানে নামিদামি রিয়েল এস্টেটের আকাশছোঁয়া অট্টালিকা আর সাজানো গোছানো ফিউশন রেস্তোরাঁর বাইরে এমন কী থাকতে পারে, সেটাই ভাবছেন। তাহলে প্রিয় পাঠক, আপনাদের বলি। আমরা গুলশানে স্ট্রিট ফুডের এক স্বর্গরাজ্য খুঁজে পেয়েছি! যেখানে এমন সব খাবার পাওয়া যায়, যা আপনাকে শেকড়ে নিয়ে যাবে।
আমাদের দিনের শুরুটা ছিল খুবই সাধারণ। পরবর্তী বড় খবরের খোঁজে আমরা অন্য দিনের মতো মাঠে নেমেছিলাম। পথে অর্কিড ভাই থেমে ছবি তুলছিলেন। ভেবেছিলেন গুলশানের ব্যস্ত দিনের ছবি তুলবেন। চকচকে গাড়ি কিংবা চমৎকার রোস্টেড কফির কাপে চুমুক দেওয়ার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করবেন। তবে আমাদের অদৃষ্টের ছিল অন্য পরিকল্পনা।
পথ চলতে চলতে কোনোভাবে আমরা মূল সড়ক ফেলে ছোট সড়কে ঢুকে পড়েছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি চারপাশে অনেকগুলো খাবারের দোকান। আর সেখানে খুব আনন্দের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করছেন কিছু মানুষ।
প্রথাগতভাবে গুলশানের যে চেহারা সবার মনে ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে এই জায়গার কোনো মিল নেই। এখানে নেই মার্বেল পাথরের কাউন্টারটপ, নেই মাচা লাতে হাতে পাউট করে ইনস্টাগ্রামের জন্য পোজ দেওয়া ইনফ্লুয়েন্সাররাও।
এখানকার তারকা বরং ফুচকা ভাই কিংবা ফুচকা মামা। নিজেদের ছোট ফুচকা বা চটপটির স্টল নিয়ে তারা এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন জীবন্ত কিংবদন্তী!
আর এই আত্মবিশ্বাস তখনই আসে যখন কারো স্ট্রিট ফুডের ব্যবসায় বছরের পর বছরের অভিজ্ঞতা থাকে। তাদের পরিবেশন করা মচমচে ফুচকা কিংবা মশলাদার চটপটি কিছুক্ষণের জন্য আপনাকে চারপাশের সবকিছু ভুলিয়ে দেবে।
তেঁতুলের টক ভরা ফুচকায় এক কামড় দিয়েই মনে হয়েছিল, আমরা বোধহয় আর গুলশানে নেই। এক নিমেষে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম ছোটবেলার হট্টগোলে ভরা গলি রাস্তায়। যেখানে এই ধরনের দারুণ স্বাদের খাবার মিলত খুব সহজে, আর অবশ্যই সস্তায়।
আমাদের এরপরের গন্তব্য রুবেল মামার শাহী হালিমের দোকান। এখানে দেশি কমফোর্ট ফুডের এমন সম্ভার আছে যা আপনার খুব খারাপ দিনকেও আনন্দময় করে দিতে পারে। রুবেল মামার দোকানে পাবেন হালিম, নিহারি, খিচুড়ি, তেহারি আর হাঁসের মাংস। কেবল নাম বলবেন, সুস্বাদু খাবার এসে হাজির হবে আপনার সামনে।
এখানে পাবেন সেই ধরনের খাবার, যেগুলো আপনার মা হয়তো বিশেষ দিনে বা বিশেষ উপলক্ষে রান্না করতেন। যা খেতে মন চাইবে, তাই হাজির হয়ে যাবে চোখের সামনে। আর দাম? অবশ্যই আপনার অতি প্রিয় ক্যাফের ক্যারামেল ফ্র্র্যাপুচিনোর চেয়ে অনেক কম।
এবার আসি কাবাব স্টেশনে। মুরগির রেশমি কাবাব, গরুর মাংসের শিক কাবাব, গুর্তা আর খিরি কাবাব ভাজার সুগন্ধে যেন ভরে ওঠে চারপাশ। এর সঙ্গে যদি পাওয়া যায় এক কাপ গরম গরম মটকা চা, তাহলে আর লাগে কী? আর সেই চা-ও পরিবেশন করা হয় চমৎকার মাটির পাত্রে।
খেয়েদেয়ে আমরা ফিরি আমাদের অনুসন্ধানে। জানতে পারি, এই সড়কটি সরগরম হয় সূর্যাস্তের পর থেকে। আর এখানে খাওয়া দাওয়া চলে ভোর প্রায় ৪টা পর্যন্ত। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন। তাই রাতের ঢাকায় ঘুরতে যারা পছন্দ করেন, এই ঠিকানাটা টুকে রাখুন।
সেখানে বসে কাবাবের আনন্দ নিতে নিতে চারপাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হলো, এই রাস্তাটি ঢাকার ছিমছাম, গোছানো চেহারার একেবারে বিপরীত।
হ্যাঁ, চারপাশে অনেক রেস্তোরাঁ আছে যেখানকার চমৎকার লাইটিংয়ের মধ্যে, গদিআঁটা চেয়ারে বসে আপনি খাবার অর্ডার করতে পারবেন। যেখানে ওয়েটাররা আপনাকে ব্যাখ্যা করবে খাবারের প্রতিটি উপাদানের বিষয়ে। কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, শেষবার কখন একটি রেস্তোরাঁ থেকে পরিতৃপ্ত হয়ে বেরিয়েছিলেন আপনি?
আপনি অনেক টাকা দিয়ে খাবার কিনে খেয়েছেন তাই ভালো লাগতেই হবে, কেবল এই ভাবনা থেকে নয়। বরং পেট এবং মন ভরে শেষ কবে কোন রেস্তোরাঁয় খেয়েছিলেন?
আমাদের মতো যারা ঢাকাতেই বড় হয়েছি, তাদের কাছে কোনো বড় রেস্তোরাঁর খাবার কখনোই স্ট্রিট ফুডকে ছাপিয়ে যেতে পারবে না। এখানে খাবার শুধু আপনার পেটই ভরাবে না, মনে করিয়ে দেবে যে আপনি কোথা থেকে এসেছেন। মনে করিয়ে দেবে, রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, হইচইয়ের কথা।
রাতের কাবাব নামে যে স্টলটি, সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত মেলে লুচি আর কাবাব। ডুবো তেলে ভাজা ফুলকো লুচি শর্করা জাতীয় খাবারের প্রতি আপনার ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে পারে।
ফাইন ডাইনে খাবারের সঙ্গে এক ধরনের সম্মান বা প্রতিপত্তি জড়িয়ে থাকে। কিন্তু এই ধরনের জায়গায় খাবার খেতে এলে যেন খাওয়ার সত্যিকারের আনন্দ পাওয়া যায়। আপনি চাইলেই ইটালিয়ান খাবার বা সুশি খেতে কোনো বড় রেস্তোরাঁয় যেতে পারেন। কিন্তু মাঝে মাঝে, মশলাদার চটপটি বা রসালো কাবাবে কামড় দিলে নিজেকে আবার অন্য রকম মানুষ হিসেবে অনুভব করতে পারবেন।
এই জায়গার সবচেয়ে ভালো দিক হলো, আপনি কেমন পোশাকে এসেছেন, আপনার খাবারের ছবি ইনস্টাগ্রামে দেওয়ার যোগ্য কি না কিংবা আপনি কীভাবে খাচ্ছেন তা কেউ ফিরেও দেখবে না। আসবেন, বসবেন আর খাবেন। তারপর খাবারগুলোই নিজেদের স্বাদের জানান দেবে।
পরেরবার যখন ঢাকার উচ্চ মানসম্পন্ন রেস্তোরাঁগুলোয় দামি স্টেক আর অ্যাভোকাডো টোস্ট খেয়ে ক্লান্ত হয়ে যাবেন, তখন চলে যেতে পারেন এখানে। গভীর রাতে কিছু কাবাব কিংবা ফুচকার সঙ্গে গুলশানের অপরিচিত রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারেন। এখানকার খাবারের স্বাদ আপনাকে নিয়ে যাবে নিজের শেকড়ে। ছোট, অপরিসর দোকানগুলোয় বসে খেতে খেতে বুঝতে পারবেন, কেন এই শহরটিকে আমরা এত ভালোবাসি।
** এখানে যে জায়গাটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটি গুলশান-২ গোল চক্করের বার্গার কিং ও ল্যাভেন্ডার সুপারস্টোরের রাস্তায় অবস্থিত।
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments