নিহারির সাত-সতেরো

নিহারি
ছবি: সাজ্জাদ ইবনে সাইদ

নিহারি হলো গরু, খাসি বা ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি এক ধরনের স্ট্যু, যা অত্যন্ত ধীর আঁচে সময় নিয়ে রান্না করতে হয়। শীতকালে নিহারি কেবল শরীরকেই উষ্ণ করে না, মনকেও শান্ত করে। উচ্চ কোলেস্টেরলের ঝুঁকির পরেও এটি অনেকেরই প্রিয় খাবার, যা শীতের মনোরম আবহাওয়ার সঙ্গে দারুণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।

 

প্রিয় পাঠক, শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কারণ এখন আমি আপনাদের এমন একটি খাবার সম্পর্কে প্রলুব্ধ করব, যা প্রতিটি কোলেস্টেরল চার্টের শীর্ষে থাকে। আর খাবারটি হলো নিহারি। ঘি আর মশলায় পরিপূর্ণ এই জনপ্রিয় খাবারটি তৈরি হয় গরু, খাসি এবং ভেড়ার পা ও অস্থিমজ্জা দিয়ে। এর আরেক নাম হলো পায়া। গরুর মাংসকে যদি কোলেস্টেরলের বোমা আখ্যা দেওয়া হয় তাহলে নিহারির নাম হবে গ্রেনেড। অনেকেই এখন এটি এড়িয়ে চলেন, তার জন্য যথেষ্ট কারণও আছে। তবে ধীরে রান্না করা এই মাংসের স্ট্যু এমন একটি সুস্বাদু পাপ যা আমরা সকলেই করতে ইচ্ছুক, তাই নয় কি?

আমরা মানুষেরা নানা দোষ-ত্রুটির সম্মিলন। আমাদের ক্ষুধা পায়, খেয়ে আমরা খুশি হই। তাই আসুন স্বীকার করি, নিহারি কেবল একটি খাবার নয়, এটি একটি আবেগের নাম। যা আমাদের মন এবং শরীরকে উষ্ণ করে। খাবারটি এমনই যে, এর প্রতিটি কামড় বা প্রতিটি চুমুকই চিকিৎসকের ভ্রু কুঁচকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে যাই বলুন না কেন, শীতকালই নিহারি খাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

এখন যখন শীত বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এবং ঠান্ডাও তুলনামূলক কম পড়তে শুরু করেছে, তখন শেষবারের মতো নিহারির স্বাদ নেওয়াই যায়। আর সেজন্য চলে যেতে পারেন লালবাগের সড়কের পাশের বিখ্যাত নিহারির দোকানগুলোয় কিংবা পুরান ঢাকার বিখ্যাত পেশোয়ারাইনে। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে এখন আপনার দরকার এক বাটি গরম গরম নিহারি এবং তার সঙ্গে নান অথবা পরোটা। কারণ, আপনি যদি শীতের সকালে এক বাটি নিহারির স্বাদে ডুব না দেন, তাহলে আমি মনে করি আপনি শীতের সঙ্গে অন্যায় করছেন।

আমরা শহরের কয়েকজন নিহারিপ্রেমীর সঙ্গে কথা বলেছি। যারা শীতকালে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে নিহারির স্বাদ গ্রহণ করেন। আর নিহারি বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনাও অনেকটা নিহারির মতোই তেলযুক্ত!

মধ্যবয়সী করপোরেট নির্বাহী নিমহাজ আহমেদ বলেন, 'ঢাকায় শীতকাল তো খুব একটা স্থায়ী হয় না। কিন্তু কেবল শীতকাল নয়, নিহারির জন্য আমার ভালোবাসা কোনও ঋতু মানে না।'

'আমি লালবাগে বড় হয়েছি। শীতের সকালে চালের আটার রুটি দিয়ে নিহারি খাওয়া আমাদের বাড়ির রীতি ছিল। নিহারির বাটিতে একটু লেবু চিপে নিয়ে তারপর রুটি বা লাচ্ছা পরোটার সঙ্গে খেয়ে ফেলুন। তাহলে আপনিও আমার মতো কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা ভুলে যাবেন।'

মিনহাজ আহমেদের মতো অনেকের কাছে শীতকালে নিহারি খাওয়া অপরিহার্য বিষয়। আবার অনেকের জন্য নিহারি সারাবছর ধরেই খাওয়ার মতো খাবার।

আবার অনেকেই আছেন, যাদের কাছে নিহারি হলো শীতকালে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য খাবার।

কথা হয় আরেক নিহারিভক্ত ইসমত হাসনাইন ও রকিবুল ইসলামের সঙ্গে।

ইসমত বলেন, 'শীতের দিনে যখন ঠান্ডা লাগবে তখন সেই ঠান্ডার সঙ্গে এক বাটি নিহারি দিয়ে লড়াই করতে হবে। এটাই আত্মরক্ষার কৌশল হতে পারে।'

রসিকতা করে রকিবুল বলেন, 'শীতে নিহারি খাওয়ার মাধ্যমে আমি কার্ডিও করি। বড় বড় হাড়গুলো হাতে তুলে নেওয়া তো এক ধরনের ব্যায়ামই, তাই না?'

ভোজনরসিক জেমিম বলেন, 'প্রথমবার যখন আমি টেলিভিশন শো ব্রুকলিক লাইন নাইনের চরিত্র চার্লস বয়েলকে খাবারের তৃপ্তির ১২টি উপাদান নিয়ে কথা বলতে শুনলাম, তখন ভাবছিলাম লোকটা পাগল নাকি? তারপর একটি আমি সকালের নাশতায় নিহারি খেলাম আর এরপরই বুঝতে পারলাম যে বয়েল আসলে কী বলতে চাইছিলেন।'

তিনি বলেন, 'খাবার কেবল চিবানো এবং গিলে ফেলার বিষয় নয়। এটি সংবেদনশীলতার পূর্ণাঙ্গ সুর। বিশ্বাস করুন, নিহারি সেই সুরের প্রতিটি লয়ের সঙ্গে তাল মেলায়। শীতের সকালে তাই নিহারি খাওয়া আমি কখনোই বাদ দিই না।'

নিহারির বিষয়ে কথা হলো অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক হামিদুর রহমানের সঙ্গে। মৃদু হেসে তিনি বলেন, 'ডাক্তারের কড়া নির্দেশ আমি যেন কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখি। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করি। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন সকালে আমি ধানমন্ডি লেকে জগিং করি। কিন্তু যখন সকালের নাশতার সময় হয় তখন জগিং থেকে সরাসরি আমি স্টার কাবাবে যাই। আর সেখানে গেলে নিহারি আর পরোটার সঙ্গে কোনও আপস করা যায় না। এটি আসলে জাতীয় নাশতা।'

আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, জগিংয়ের পর হামিদুর রহমান নিজেকে নিজে ট্রিট দিতেই পারেন। আর সেটায় দোষের কিছু নেই।

যারা জানেন না, তাদের বলি। ধারণা করা হয়, নিহারির জন্ম মুঘলদের রান্নাঘরে। যেখানে এটি সৈনিকদের বিশেষায়িত নাশতা হিসেবে তৈরি করা হতো। যেন সকালবেলা নিহারি দিয়ে নাশতা করে তারা সারাদিনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করতে পারেন।

তাহলে এবার বলুন, আমরা কি সকাল বেলা দৌড়ঝাঁপের পর হামিদুর রহমানের এক বাটি নিহারি খাওয়াকে দোষের বলতে পারি? শীতের সকালে এক বাটি নিহারির আনন্দ ছাড়া জীবনে আর আছে কী? তো চলুন, আমরা স্বীকার করে নিই, ঢাকায় বেঁচে থাকা কোনও যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। তাই হামিদুর রহমান যদি তার যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে এক বাটি নিহারি আর পরোটাকে বেছে নেন, তাতে দোষের কিছু নেই। বরং আমরা বলতে পারি, তিনি বিজয় অর্জন করে এই নাশতা বেছে নিয়েছেন। আমাদের সবারও তাই করা উচিত।

যদি কোনো হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এই লেখাটি পড়ে থাকেন, দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন!

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

Jucsu election set for July 31 after 33-year gap

The first election to the Jahangirnagar University Central Students' Union (Jucsu) in 33 years will be held on July 31

1h ago