ক্ষীরপুরির স্বাদের জাদু

ক্ষীরপুরি

ইতিহাসসমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত মাদারীপুর। দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাবার জন্য মাদারীপুরে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক মিষ্টি, যার অন্যতম ক্ষীরপুরি। ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টি এখন যেন মাদারীপুরের প্রতীক হয়ে উঠেছে। কেবল এই মিষ্টির আকর্ষণেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এখানে বেড়াতে যান। ক্ষীরপুরি স্বাদ না নিলে মাদারীপুর ভ্রমণ সঠিকভাবে শেষ হয় না। সেইসঙ্গে শহর থেকে যাওয়ার সময় কেউই তাদের প্রিয়জনদের জন্য ক্ষীরপুরি নিয়ে যাওয়ার কথা ভোলেন না।

মিষ্টি

মাদারীপুরের অনেক মিষ্টির দোকানের মধ্যে অন্যতম হলো জীবন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। কিংবদন্তী এই দোকানটি প্রায় ৮০ বছর ধরে মিষ্টি বিক্রি করে চলেছে। শহরের পুরোনো আদালত এলাকায় এর অবস্থান। আপনি যদি মিষ্টিপ্রেমী হয়ে থাকেন তাহলে এ দোকানটিতে একবার হলেও যেতে ভুলবেন না। তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টি হলো ক্ষীরপুরি। তবে তাদের রসগোল্লা, রসমালাই এবং ছানার জিলাপিও স্থানীয়দের কাছে সমান জনপ্রিয়।

জীবন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পথচলা শুরু হয় ১৯৩০ সালে। জীবন মণ্ডল নামের এক ব্যক্তি এই দোকান চালু করেন। শুরুতে কেবল রসগোল্লা তৈরি করতেন। সময়ের সঙ্গে তালিকায় যুক্ত হয় ক্ষীরপুরি, যা তার দোকানের সিগনেচার মিষ্টি হিসেবে পরিণত হয়। জীবন মণ্ডলের পর দোকানের দায়িত্ব নেন তার ছেলে কানাই মণ্ডল। এখন সেই ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন জীবনের নাতি আকাশ মণ্ডল। তৃতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে এখন দোকানটি পরিচালনা করছেন তিনি। এক সময়ের ছোট আর সাধারণ দোকানটি এখন পরিণত হয়েছে মাদারীপুরের সুপরিচিত স্থানে, যা দর্শনার্থীদেরও প্রধান আকর্ষণ।

কথা হয় আকাশ মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি ক্ষীরপুরি তৈরির প্রক্রিয়াটি আমাদের ব্যাখ্যা করে শোনান।

মাদারীপুর

তিনি বলেন, 'প্রতিদিন আমাদের গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা গরুর তাজা দুধ দিয়ে ক্ষীরপুরি তৈরি করা হয়। প্রথমেই এই দুধ অল্প আঁচে জ্বাল দেওয়া হয়। এটি ততক্ষণ জ্বাল দেওয়া হয় যতক্ষণ না আমাদের কাঙ্ক্ষিত ঘনত্বে পৌঁছছে। তারপর এই মসৃণ আর মাখনের মতো নরম ক্ষীর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সাবধানে তা ঢেলে দেওয়া হয় ছানার একটি স্তরের ওপর। ফলাফল হিসেবে পাওয়া যায় যথাযথ স্বাদের মিষ্টান্ন, যা খুব কড়া মিষ্টি নয় বরং বেশ হালকা বা ঠিক স্বাদের মিষ্টি।'

দোকানটিতে এখন প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ কেজি ক্ষীরপুরি বিক্রি করা হয়। যার প্রতি পিসের দাম ৩০ টাকা আর প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৬৫০ টাকায়।

এখন প্রশ্ন হলো, জীবন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ক্ষীরপুরি কেন এত বিখ্যাত?

আকাশ মণ্ডলের মতে, এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে তাদের উপকরণের গুণমান এবং ঐতিহ্যবাহী রান্নার প্রক্রিয়ার মধ্যে।

তিনি বলেন, 'প্রতিদিন একইভাবে গ্রাম থেকে গরুর খাঁটি দুধ সংগ্রহ করি আমরা। এরপর আমার দাদা যে পদ্ধতিতে মিষ্টি বানাতেন এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করি। এই কারণেই আমাদের ক্ষীরপুরির স্বাদ আজও একইরকম আছে, যেমনটি বহু বছর আগেও ছিল।'

ক্ষীরপুরি সবচেয়ে জনপ্রিয় হলেও এটি জীবন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের একমাত্র তারকা নয়।

মিষ্টি

দোকানের কর্মচারী সৌরভ বলেন, 'আমাদের রসগোল্লাও দারুণ জনপ্রিয়। এছাড়া অনেকের কাছেই আমাদের ছানার জিলাপিও ভীষণ প্রিয়।'

কিছুদিন আগেই আমি আর আমার বন্ধুর সুযোগ হয়েছিল জীবন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টির স্বাদ নেওয়ার। আমরা শুরু করেছিলাম রসগোল্লা দিয়ে। মিষ্টিগুলো ছিল উষ্ণ আর নরম। মুখে দিতেই মিলিয়ে যাচ্ছিল। এরপর চেখে দেখি ছানার জিলাপি, যা ছিল রসগোল্লার মতোই সুস্বাদু। বাইরের দিকটি ভাজা, ভেতরটুকু নরম-রসালো। মিষ্টির স্বাদটিও এরদম যথাযথ, বাড়তি মিষ্টি নয় বরং বেশ ভারসাম্যপূর্ণ।

কিন্তু এরপর যখন আমরা ক্ষীরপুরির স্বাদ নিলাম তখন মনে হলো জাদুকরী কিছু মুখে দিলাম। অনেকটা মাখনের মতো ঘনত্ব, মিষ্টির পরিমাণও যথাযথ। মুখে দিয়েই আমরা এর প্রেমে পড়তে বাধ্য হলাম। খুব বেশি মিষ্টি নয়, আবার একেবারে কমও নয়। ঠিক এমন স্বাদ আর ঘনত্ব, যা মিলে তৈরি করেছে নিখুঁত ভারসাম্য। মিষ্টি খেয়ে বের হওয়ার আগে পরিবারের সদস্যদের জন্যও এক বাক্স ক্ষীরপুরি কিনে নিয়েছিলাম। আমি জানতাম, তারাও আমাদের মতোই এর স্বাদ পছন্দ করবেন।

জীবন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার দুয়ার খোলে প্রতিদিন সকাল ৭টায়। রাত ১০টা পর্যন্ত চলে বিকিকিনি। পুরো দিন ধরেই স্থানীয়দের পাশাপাশি দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে এই দোকান। কোনো উৎসব হোক কিংবা পারিবারিক মিলনমেলা, মাদারীপুরের মানুষের খাবার টেবিলে জীবন মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি লাগবেই। এমনকি সাধারণ দিনেও রসনা মেটাতে তারা দারস্থ হন দোকানটির। কিছু কিছু গ্রাহক আছেন যারা কয়েক দশক ধরে নিয়মিতভাবে জীবন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টিই কিনছেন। তাদের মতে, এই দোকানের মিষ্টি তাদের শৈশবের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।

সময়ের সঙ্গে জীবন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এখন মিষ্টির দোকানের চেয়ে বেশি কিছুতে পরিণত হয়েছে। এটি এখন মাদারীপুরের পরিচয়ের একটি অংশ। তিন প্রজন্ম ধরে অক্ষুণ্ণ থাকা গুণমান ও স্বাদ এটিকে ঐতিহ্যের প্রতীকে পরিণত করেছে। আপনি যদি কখনও কোনো কাজে বা বেড়াতে মাদারীপুরে যান তাহলে বিখ্যাত এই ক্ষীরপুরির স্বাদ নিতে ভুলবেন না। আর অবশ্যই বাড়ির লোকেদের জন্যও কিছু মিষ্টি কিনে নিয়ে যাবেন, যেমনটি আমরা নিয়েছিলাম।

ছবি: জাওয়াদ সামি নিয়োগী

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

Arrest of Nusraat Faria 'mockery' of judicial process: NCP

Demands visible progress into the trial of the July killings by next July

1h ago