ঘন ক্ষীরে তৈরি সরিষাবাড়ীর সুস্বাদু প্যারা সন্দেশ খেয়েছেন কি

গরুর খাঁটি দুধের ঘন ক্ষীর এবং চিনির মিশ্রণে তৈরি হওয়া এই মিষ্টির স্বাদ অন্য মিষ্টির চেয়ে একটু আলাদা। শুকনো হওয়ায় দূর-দূরান্তে বহনেও বেশ সুবিধা।
ছবি: শহিদুল ইসলাম নিরব

প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির খাদ্যতালিকায় মিষ্টি ও মিষ্টি জাতীয় খাবারের গুরুত্ব অনেক বেশি। জন্মদিন, বিয়েসহ যেকোনো শুভ সংবাদে পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনের মাঝে মিষ্টি বিতরণ বাঙালির চিরকালীন প্রথা। আর অনেক রকম মিষ্টির ভীড়ে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার প্যারা সন্দেশ। এখন ইউরোপে যাওয়ায় সেখানকার অনেক বাংলাদেশি প্রবাসীরও প্রিয় মিষ্টি খাবার হয়ে উঠেছে এটি।

গরুর খাঁটি দুধের ঘন ক্ষীর এবং চিনির মিশ্রণে তৈরি হওয়া এই মিষ্টির স্বাদ অন্য মিষ্টির চেয়ে একটু আলাদা। শুকনো হওয়ায় দূর-দূরান্তে বহনেও বেশ সুবিধা। ফলে অনেকের কাছে রসালো মিষ্টির চেয়ে এই মিষ্টির চাহিদা বেশি। উপজেলায় অনেক মিষ্টির দোকান থাকলেও কালাচাঁদ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, মধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, বর্ধন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, সংগীতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে তৈরি হওয়া প্যারা সন্দেশের নাম বেশি। স্বাদে অতুলনীয় এগুলো।

উপজেলার মিষ্টি ব্যবসায়ীরা জানান, সরিষাবাড়ীতে এসেছেন আর প্যারার স্বাদ নেননি এমন লোক পাওয়া মুশকিল। এটি এ অঞ্চলের গর্ব। বাপ-দাদার আমল থেকেই তারা এটি তৈরি করছেন। হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দুধের ক্ষীর এবং আখের রসের মিশ্রণে এক ধরনের মিষ্টান্ন তৈরি হতো। সেই থেকে ধীরে ধীরে প্যারা সন্দেশ বা মিষ্টিতে রূপান্তর হয়। এটি তৈরিতে পরিশ্রম বেশি হলেও ব্যাপক চাহিদা থাকায় উপজেলার প্রত্যেকটি মিষ্টির দোকানে এটি পাওয়া যায়। যারা এর ভক্ত, তারা রীতিমতো ফরমায়েশ দিয়ে আনিয়ে নেন। বর্তমানে এই 'প্যারা সন্দেশ' যুক্তরাজ্য -ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে।

সরিষাবাড়ীর বাসিন্দা জাকারিয়া জাহাঙ্গীর। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি প্যারা সন্দেশের ব্যাপক ভক্ত। শুধু তিনি নন, তার পরিবারের সবাই এই সন্দেশ খেতে খুব পছন্দ করেন।

তিনি বলেন, 'প্যারা সন্দেশ স্বাদে-মানে ও গুণে অতুলনীয়। এটি শুকনো থাকায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। সম্প্রতি বগুড়ার দইকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তেমনিভাবে আমরা সরিষাবাড়ীবাসীও চাই সরিষাবাড়ীর এই ঐতিহ্যবাহী প্যারা সন্দেশকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।'

বর্ধন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে রাসেল মিয়া নামে এক ক্রেতার দেখা মেলে। তিনি কিছু কাজে জেলা শহর থেকে সরিষাবাড়ীতে এসেছেন।

তিনি বলেন, 'সরিষাবাড়ীতে এলেই পরিবারের জন্য এই বিখ্যাত প্যারা সন্দেশ নিয়ে যাই। পরিবারের সবার খুবই প্রিয় এই সুস্বাদু খাবার। বিশেষ করে শিশুরা খুবই পছন্দ করে এই মিষ্টি। আমরা চাই বিখ্যাত এই প্যারা সন্দেশের সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক।'

উপজেলার শিমলাবাজারের কাঁলাচাদ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী সুমন ঘোষ জানান, প্রতিদিন তার দোকানে বিভিন্ন রকম মিষ্টি তৈরি হলেও সবার চাহিদা প্যারা সন্দেশ। এটি এই অঞ্চলের ঐতিহ্য। প্রতিদিন তার দোকানে গড়ে ৮০-১০০ কেজি প্যারা মিষ্টি তৈরি হয়। নিজ উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে ময়মনসিংহ, শেরপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানেই এই প্যারা সন্দেশ সরবরাহ করে থাকেন তিনি।

তিনি জানান, তার দোকানের প্যারা সন্দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ইতালি, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, দুবাই প্রবাসীদের কাছেও সরবরাহ করা হয়ে থাকে। শুকনো মুড়ির পাত্রে দেড় থেকে দুই মাস সংগ্রহ করে খাওয়া যায় বিধায় বিদেশে থাকা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে প্যারার কদর একটু বেশি।

তিনি আরও জানান, এই মিষ্টির সবটুকুর জন্যই দুধের ওপর নির্ভর করতে হয় বলে অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় দাম একটু বেশিই হয়ে থাকে। একসময় ৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ১ কেজি প্যারা মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৫০০ টাকা দরে। ৪০-৪৫টি প্যারা মিষ্টি এক কেজি ওজনের হয়ে থাকে।

কারিগর চন্দন পাল ৩০ বছর ধরে তিনি প্যারা মিষ্টি তৈরির সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, 'বাইরে থেকে দেখে প্যারা সন্দেশ বানানো সহজ মনে হলেও ততটা সহজ নয়। দুধের ক্ষীর তৈরি করে তাতে চিনি ও ক্ষীরের মিশ্রণের একটা সঠিক অনুপাত প্রয়োজন হয়। আর এই অনুপাতের তারতম্য ঘটলে এর স্বাদ ও গুণগত মান দুটোই নষ্ট হয়ে যায়।'

কারিগর হিসেবে দেশের অনেক অঞ্চলের প্রসিদ্ধ মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ করলেও সরিষাবাড়ীর প্যারা সন্দেশের স্বাদ দেশের অন্য অঞ্চলের মিষ্টির চেয়ে সেরা বলে মনে করেন তিনি।

জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, 'দেশের প্রত্যেক এলাকায় বিশেষ ধরনের মিষ্টি তৈরি হয়। যেমন নাটোরের কাঁচাগোল্লা, বিক্রমপুরের মিষ্টি-দই, বগুড়ার দই, কুমিল্লার রসমালাই। তেমনি জামালপুরেও মিষ্টি ক্ষেত্রে বিশেষত্ব থাকলেও প্রচার-প্রচারণার অভাবে এটি পরিচিতি পায়নি। সরিষাবাড়ী উপজেলার প্যারা সন্দেশ বেশ প্রসিদ্ধ। তবে নাটোরের, কুমিল্লা, বগুড়া, বিক্রমপুরের মতো এত জাতীয়ভাবে পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। জামালপুর হয়ে খুব কম জেলার লোক যাতায়াত করে। এইজন্য এই সুস্বাদু মিষ্টি তেমন পরিচিতি পায়নি বলে মনে করেন তিনি।

 

Comments