অর্থ সঞ্চয়ে কোটিপতিদের ১০ পরামর্শ

সঞ্চিত অর্থ আপনার জীবনকে নিরাপদ ও চিন্তামুক্ত রাখবে।
ছবি: সংগৃহীত

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বিভিন্ন বিপদ-আপদে সঞ্চিত অর্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পর্যাপ্ত সঞ্চয় থাকলে তুলনামূলক কম বয়সে অবসরে যাওয়া যায়, পৃথিবীকে আরও ভালোভাবে উপভোগ করা যায়। এ ছাড়া জরুরি মুহূর্তে অর্থের জোগান নিয়ে বাড়তি চিন্তা করতে হয় না। মোট কথা, সঞ্চিত অর্থ আপনার জীবনকে নিরাপদ ও চিন্তামুক্ত রাখবে।

কিন্তু কীভাবে অর্থ সঞ্চয় করবেন? এ বিষয়ে 'সেলফ মেইড' কোটিপতিদের পরামর্শ জানাচ্ছে রিডার্স ডাইজেস্ট-

ক্রেডিট কার্ড থেকে দূরে থাকুন

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষ ধনী মার্ক কিউবান বলেন, 'ক্রেডিট কার্ড সবচেয়ে ভালো সঞ্চয়কারীকেও ভুল পথে চালিত করতে পারে।' মার্কিন ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট বিজনেস ইনসাইডারকে দেওয়া এক স্বাক্ষাৎকারে ক্রেডিট কার্ডকে 'সবচেয়ে খারাপ বিনিয়োগ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। ক্রেডিট কার্ডের বিল যথাসময়ে না দিলে উচ্চ হারে সুদ দিতে হয়। ক্রেডিট কার্ড হাতে থাকলে মানুষের খরচের পরিমাণও বেড়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে অর্থ প্রদানের সময় ক্রেতারা ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ব্যয় করেন। এমনকি কোনো পণ্য নগদ অর্থে কিনলে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতেন, ক্রেডিট কার্ডে কিনলে তার দ্বিগুণ অর্থ প্রদানেও ক্রেতাদের আপত্তি থাকে না। 

 

নিজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করুন

অর্থ সঞ্চয়ে আপনি কতটা কার্যকর কিংবা কত অর্থ সঞ্চয় করলেন, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন। এতে যেমন নিজেকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাবে, তেমনি সঞ্চয়ের জন্য অনুপ্রেরণা আরও বাড়বে। নিজের অগ্রগতির প্রতি নজর রাখার দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী বিল গেটসও। ২০১৩ সালে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের জন্য লেখা বার্ষিক চিঠিতে তিনি বলেছেন, 'আপনি যদি একটি স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেন এবং সে লক্ষ্যে অগ্রগতি পরিমাপ করেন, তাহলে অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া সম্ভব।'

বাজেট অ্যাপ বা কোথাও লিখে হিসাব রাখতে পারেন। এতে আপনার সঞ্চয় প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হবে।

অনাড়ম্বর জীবনযাপন করুন

একটা কথা আছে, '১ টাকা সঞ্চয় করলেন মানে ১ টাকা আয় করলেন'। কথাটা একদম ঠিক। অনাড়ম্বর জীবনযাপনের মাধ্যমে অনেক অর্থ সঞ্চয় করা সম্ভব। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ওয়ারেন বাফেট তার অনাড়ম্বর জীবনযাপনের জন্য বিখ্যাত। তিনি খুব সাধারণ একটি ফোন ব্যবহার করেন, ১৯৫৭ সালে কেনা বাড়িতে এখনও বসবাস করেন এবং উড়োজাহাজের সাশ্রয়ী আসনে ভ্রমণ করেন।  

অন্যতম শীর্ষ তেল ব্যবসায়ী টি. বুনের দর্শনও একই। তিনিও খুব সাধারণ জীবনযাপনের জন্য বিখ্যাত। তার আলমারিতে একেবারে মৌলিক কিছু জিনিস ছাড়া অন্য কিছু নেই।

'মানুষ অবাক হয়ে যায়, যখন দেখে আমার আলমারি ভর্তি স্যুট নেই। প্রতি ৫ বছর পর পর আমি ৩টা করে স্যুট কিনি। মোট ১০টি স্যুট আছে আমার। এর বেশি প্রয়োজন নেই', তিনি বলেন।   

অল্প থেকেই শুরু করুন

সেলফ মেইড কোটিপতি ক্রিস রেইনিং আইটি খাতে গতানুগতিক চাকরি করতেন। কিন্তু তার উপার্জনের অর্ধেকই তিনি সঞ্চয় করতেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে কোটিপতি হন তিনি আর ৩৭ বছর বয়সে অবসরে যান। কীভাবে তিনি এত অল্প সময়ে এত সঞ্চয় করলেন জানতে চান? ছোটখাট অপ্রয়োজনীয় খরচ ও কেনাটাকাটা বাদ দিয়ে।

মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আমি জানি কেউ কেউ বলবেন, ৫ ডলারের কফি নিয়ে এত চিন্তার কী আছে? কিন্তু এই ৫ ডলার সঞ্চয়ও তো খারাপ না। ছোট ছোট অঙ্কে হলেও সঞ্চয় করুন। এসব ছোট ছোট পরিবর্তন এক সময় বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে।'

স্বপ্ন বড় রাখুন

ছোট ছোট খরচ এড়ানোটা সঞ্চয় শুরুর জন্য ভালো। তবে ধনীরা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পরামর্শ দেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে কোটিপতি হওয়া ইনটু দ্য এএম এবং আইহার্টরেভসের সিইও ব্রয়ান লিম বলেন, 'আমার করা সবচেয়ে বড় আর্থিক ভুল হলো যথেষ্ট বড় চিন্তা না করা। আগে নির্ধারণ করুন কত অর্থ সঞ্চয় করতে পারলে আপনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবেন। এরপর সেই পরিমাণ অর্থ সঞ্চয়ের জন্য প্রতি মাসে কেমন উপার্জন করতে হবে, তা হিসাব করুন এবং সেই অনুযায়ী উপার্জনের চেষ্টা করুন।'

একাধিক উৎস থেকে আয় করুন

সেলফ মেইড কোটিপতিদের ওপর ৫ বছর ধরে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের সবারই আয়ের একাধিক উৎস ছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৫ শতাংশ ধনীর আয়ের উৎস ছিল ৩টি, ৪৫ শতাংশ ধনী ৪টি উৎস থেকে আয় করেছেন আর ২৯ শতাংশ ধনী ৫টি বা এর বেশি উৎস থেকে আয় করেছেন। গবেষণায় বলা হয়েছে, 'আপনি জীবনে যত বেশি আয়ের প্রবাহ তৈরি করতে পারবেন, আপনার আর্থিক জীবন তত বেশি সুরক্ষিত হবে।'

কমেডিয়ান জে লেনো, যিনি প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের মালিক বলে অনুমান করা হয়, তারও আয়ের উৎস ২টি। তিনি বলেন, 'একটি আমি সঞ্চয় করি, আরেকটি খরচ করি।'

সফলদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখুন

'হাউ রিচ পিপল থিংক' বইয়ের লেখক এবং কোটিপতি স্টিভ সাইবোল্ড বলেন, 'আপনার সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ নির্ভর করবে কারা আপনার বন্ধু তার ওপর।'

বিজনেস ইনসাইডারের কলামে তিনি লিখেছেন, 'বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কারা, তার ওপর আপনার অর্থের পরিমাণ নির্ভর করে। আপনার চেয়েও সফল, এমন মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখুন। তারা আপনার চিন্তাধারা বদলে দিতে ভূমিকা রাখবেন। আপনার আয়ের ওপর যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।'

৫০-৩০-২০ নীতি অনুসরণ করুন

জটিল বাজেটের কথা ভুলে যান। বড় সঞ্চয়ের রহস্য মাত্র ৩টি সাধারণ সংখ্যার মধ্যেই নীহিত। অর্থবিষয়ক অন্যতম জনপ্রিয় ওয়েবসাইট দ্য পেনি হোর্ডারের প্রতিষ্ঠাতা কাইল টেইলর সিএনবিসিকে বলেছেন, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ৫০-৩০-২০ নীতি অনুসরণ করে তিনি কয়েক মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছেন।

এই নীতি অনুসরণ করে টেইলর তার আয়ের ৫০ শতাংশ অর্থ সঞ্চয় ও দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর পেছনে ব্যয় করেছেন, ৩০ শতাংশ অর্থ জীবনযাপনের জন্য কেনাকাটা যেমন- জামাকাপড় কেনা এবং বাকি ২০ শতাংশ অর্থ বিনোদনের পেছনে খরচ করেছেন।

আয় বাড়লেই ব্যয় বাড়িয়ে দেবেন না

সেলফ মেইড কোটিপতি টম কোর্লি বলেন, ধনীরা তাদের আয় বাড়লেই জীবন যাপনের ব্যয় বাড়িয়ে দেন না।

তিনি বলেন, 'যারা হঠাৎ করে অনেক অর্থের মালিক হয়েছেন, তাদের অনেকেই এই কাজটা করেন। আপনি যখন অর্থ খরচ করবেন, এটি চিরতরে আপনার হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপর যদি কোনো বিপদে পড়েন- যেমন চাকরি চলে যেতে পারে, তখন জীবনধারণের জন্য আপনার মালিকানাধীন বিভিন্ন কিছু বিক্রি করে দিতে হতে পারে। ক্রয়কৃত জিনিসটির যদি দাম কমে যায়, তাহলে লোকসানে বিক্রি করতে হবে। তাই বাড়তি উপার্জন সঞ্চিত রাখুন।'

কৃপণ নয়, মিতব্যয়ী হোন

টম কোর্লি পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ৬৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ স্বীকার করেছেন তারা সস্তা পণ্য ও সেবা কেনেন। সস্তা পণ্য মানসম্পন্ন পণ্যের তুলনায় অনেক দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

কোর্লি বলেন, 'যারা সস্তায় বিভিন্ন সেবা দেন, তারা মূলত অদক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট কাজে তাদের পারদর্শিতা কম। সস্তায় সেবা নিতে গেলে অনেক বড় বিপদে পড়তে পারেন। যেমন- আপনি যদি ট্যাক্স ও আইনি বিষয়ে পরামর্শের জন্য অদক্ষ কারো সেবা নেন, তাহলে লাভের চেয়ে লোকসানের আশঙ্কাই বেশি '

তাই ভালো সেবা ও পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করুন। এটা দীর্ঘমেয়াদে সুফল নিয়ে আসবে।

Comments