অর্কিডের বাহার

একক ও নানা মিশ্র রঙের একেকটি অর্কিড ফোটে, আর রঙের জলসা বসে ছাদে।
ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

'অর্কিড' শুনলেই প্রাকৃতিক বন, সেই বনের ভেতর চেনা-অচেনা ছোট-বড় গাছ, সেই গাছগাছালিতে অন্যরকম ফুল চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যে ফুল সেই গাছের না, সে ফুল অন্য প্রজাতির। তবে জাতপাত যাই থাক, তারা গা জড়াজড়ি করেই থাকে, একসাথে বাঁচে। যতদিন গাছ আছে, সেই ফুলও আছে। এ বাঁধন যেন বন্ধুত্বের, প্রাণের।

মৌলভীবাজারের নারী উদ্যোক্তা, অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটার দোকান মনিপুরি হ্যান্ডিক্রাফ্টের মালিক সোনিয়া মান্নান সেই ছোটবেলাতেই এমন সাব গাছ-গাছড়ার মাধ্যমেই অর্কিডের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। সেই বুনো ফুল, বুনো গন্ধ মনের মধ্যে জায়গাজুড়ে ছিল। একদিন তাদের বাসার ছাদে আরও সব ফুল-ফল, সবজি-আনাজের সঙ্গে অর্কিডও চলে আসে। মন ও চোখকাড়া অর্কিডের একেকটি ফুল যখন হেসে উঠে, তাতে ছাদটা রঙিন হয়ে যায়।

মৌলভীবাজার শহরের পিটিআই (প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র)-সংলগ্ন তাদের বাসার ছাদটিতে প্রায় ১২ মাসই কোনো না কোনো অর্কিড ফুটছে। একক ও নানা মিশ্র রঙের একেকটি অর্কিড ফোটে, আর রঙের জলসা বসে ছাদে। এই রঙের রানিদের কাছে পেতে বেশ খাটাখাটনিও গেছে তার। কখনও গাছ মরে গেছে। ফুলের আর দেখা মেলেনি। কিন্তু উদ্ভিদ বিজ্ঞানে পড়ুয়া এই উদ্যোক্তা অর্কিডে মজেই ছিলেন, তাই হাল না ছেড়ে একের পর এক অর্কিড সংগ্রহ করেছেন, যত্ন-পরিচর্যা করেছেন। একদিন ফুলেরও দেখা পেলেন। এখন অন্তত ২০ জাতের অর্কিড তার ছাদে। ছাদজুড়ে দেখা গেছে অর্কিড ছাড়াও বিভিন্ন জাতের ফুল ও সবজি টবে লাগানো আছে। সেসবের ফাঁকে-ফাঁকে অর্কিডের গাছ। কোনোটা ফুল-পাপড়ি মেলেছে। সব ফুল তো আর একসাথে ফোটে না, একটা ফোটে আর রঙের আলো আসে।

ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

সোনিয়া মান্নান বলেন, 'ছোটবেলায় দেখতাম গাছে গাছে একরকম ফুল ফুটত। বেশ সুন্দর, বেশ ঘন হয়ে একটা ডালে ছোটছোট ফুল একসাথে ফুটে আছে। চমৎকার নজরকাড়া বেগুনি আর সাদার মিশেলে ছিল সেই ফুলগুলো। হালকা একটা বুনো গন্ধও ছিল। আর গাছটাও কিরকম অদ্ভুত, আরেকটা গাছের উপর জন্মে থাকে। মাটি লাগে না, পানি দেওয়া লাগে না। কোনো যত্ন লাগে না। নামটাও কি সুন্দর, অর্কিড।' তিনি বলেন, 'আমরা খেলার জন্য ফুলটা পেড়ে আনতাম। মাথার চুলে গেঁথে রাখতাম। সেই প্রথম অর্কিডের সঙ্গে স্মৃতি।'

ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

তিনি জানিয়েছেন, অর্কিড একধরনের পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ। এটি গাছের কাণ্ডে হয়ে থাকে। যে গাছে হয়, সেই গাছ থেকেই পুষ্টি সংগ্রহ করে বাঁচে। আবার কিছু অর্কিড মাটিতে, পাথরের খাঁজে হয়ে থাকে। ফুলটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর আকর্ষণীয় রং, বিভিন্ন ধরনের গড়ন, সুগন্ধ, ওষুধি গুণাগুণ, দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল। তার ছোটবেলায় দেখা অর্কিডের মধ্যে শুধু ফক্সটেল আর পেন্সিল অর্কিডই ছিল। ২০০০/২০০১ সালের দিকে জানতে পারেন বিশ্বে আরও অনেক ধরনের অর্কিড আছে।তখন বাংলাদেশে অল্পকিছু অর্কিড মিললেও মৌলভীবাজারের কোনো নার্সারিতে অর্কিড পাওয়া যেত না। ঢাকা থেকে এক-দুইটা করে গাছ সংগ্রহ করেন। অভিজ্ঞতা না থাকায় কিছুদিন পরেই গাছগুলো মারা যায়।

তারপর ২০০৪ সালে তিনি থাইল্যান্ড ও ফিলিপিন্সে যান। সেখানে অনেক রকমের অর্কিড দেখতে পান। ফিলিপিন্সে একটা ফার্ম দেখেন, যেখানে তারা গাছের কাণ্ড কেটে তার মধ্যে অর্কিড করেছে। ওরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করত। সে সময় তার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থাইল্যান্ড থেকে তাকে এক বোতল টিস্যু কালচার করা অর্কিডের চারা উপহার দেন। তিনি সাধ্যমতো সেগুলোর পরিচর্যা করেন। কিন্তু কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও ফুলের দেখা পাননি। পরে একবার ঢাকায় বৃক্ষমেলায় যান। সেখানে একটা নার্সারিতে বিভিন্ন জাতের অর্কিড দেখেন। দাম জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু কেনেন না। একপর্যায়ে তাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে একটি নার্সারির লোকজন তাকে বসতে বলে। ঘোরাঘুরির কারণ জানতে চায়। ওদের সাথে আলাপে তার অর্কিডগুলো বাঁচে না শুনে ওরা তাকে ড্যান্সিং লেডি ও ডেন প্যারিশি নামের দুটি অর্কিড নেওয়ার কথা বলে। এগুলো খুব সহজে হয়। এগুলো যদি হয় এরপর অন্যগুলো নেবার পরামর্শ দেয় তারা। এটা ২০০৬ সালের দিকের ঘটনা। তাদের কথামতো তিনি ওই দুই জাতের অর্কিড নিয়ে আসেন। বারান্দায় ঝুলিয়ে দেন। সকাল-বিকাল পানি দেন, যত্ন করেন।

ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

সোনিয়া মান্নান বলেন, 'অনেক প্রতীক্ষার শেষে যেদিন প্রথম ফুল ফুটল, আমি খুব খুশি।' তারপর একটা একটা করে গাছ কেনেন। যত্ন-পরিচর্যা করেন। কয়েকবছর পর গাছগুলো মরে যায়। অনলাইন থেকেও গাছ কিনেছেন। এতে মাঝেমাঝেই ঠকেছেন। যেটা দেবে বলেছে, সেটা না দিয়ে অন্যটা দিয়েছে। কখনো বয়স্ক গাছ, কখনো শিকড় পচা, কখনো ফাঙ্গাসে আক্রান্ত অসুস্থ গাছ দিয়েছে। এখন আর অনলাইনে কেনেন না। এখন মাঝেমাঝে অন্যের সাথে বিনিময় করেন। মাঝেমাঝে বিক্রিও করেন। এখন তার ছাদ বাগানে ওনিসিডিয়াম, ডেনড্রোবিয়াম, এগ্রিগেটাম, এরাইডাস, ক্যাটেলিয়া, মোকারা, টলুমনিয়া, সিম্বিডিয়াম, ফারমোসাম এই গোত্রের প্রায় ২০ ধরনের অর্কিড আছে। তিনি তার অর্কিডগুলোকে ছাদে ঝুলিয়ে রেখেছেন। গাছ ছায়া ও রোদ প্রাকৃতিক ভাবেই পায়। তিনি সকালে-বিকালে পানি স্প্রে করেন।

প্রয়োজনীয় অন্যান্য পরিচর্যা করেন। অর্কিডগুলোও তাকে কাছেরই ভেবে নিয়েছে। সময়ে সময়ে তারা পাপড়ি মেলছে, হেসে উঠছে। এইসব মন ভালো হওয়া মুহূর্তগুলোর তো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তুলনা নেই। তার ছাদে এখন একটি অর্কিডের সাথে নতুন আসা কোনো অতিথিই কেবল নির্বিরোধ প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু ফুল ও রঙের বৈচিত্র্যকেই সমৃদ্ধ করে।

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

2h ago