বিমানবন্দর নয়, এ যেন বিলাসবহুল কোনো আধুনিক শহর
চাঙ্গি বিমানবন্দরকে শুধু সিঙ্গাপুরের বিস্ময় বললে কম বলা হবে। আধুনিকতা ও বিলাসিতার সমন্বয়ে তৈরি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এই বিমানবন্দরটি সারা বিশ্বেই পরিচিত এর অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য। মানুষ কোনো গন্তব্যে যেতে বিমানবন্দর ব্যবহার করে। কিন্তু চাঙ্গি বিমানবন্দর নিজেই যেন একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য।
সুযোগ-সুবিধা, আরাম, যাত্রীদের জন্য বিভিন্ন বিনোদনমূলক ব্যবস্থার সমন্বয়ে তৈরি বিশ্বের সেরা এই বিমানবন্দরটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যে, এটি গতানুগতিক খোলসে আটকে না থেকে নিজেই একটি পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। পার্ক, গার্ডেন, শপিং মল, বিয়ের আয়োজন থেকে শুরু করে কী নেই এতে! এ যেন বিমানবন্দর নয়, অত্যাধুনিক কোনো শহর।
যেন এক বিনোদনকেন্দ্র
অনেকেই ছুটির দিনে পরিবার পরিজন নিয়ে চাঙ্গির টার্মিনাল ১ এর সঙ্গে সংযুক্ত ১৫ লাখ বর্গফুট আয়তনের জুয়েল শপিং মলে ঘুরতে যান। দৃষ্টিনন্দন এই শপিং মলটির নকশা করেছেন বিখ্যাত কানাডীয় স্থপতি মোশে সাফদি ও তার দল। এখানেই গড়ে তোলা হয়েছে ৭ তলা বিশিষ্ট কৃত্রিম ঝরনা, যা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ইনডোর ঝরনার খেতাব পেয়েছে। শপিং মলটিতে ডিজনির আদলে তৈরি লাইট ও মিউজিক শোর ব্যবস্থাও আছে।
অনেকেই সারাদিন কাটানোর জন্য চাঙ্গিতে যান। বিমানবন্দরটিতে পাতাল রেল ও বাসে করে খুব সহজেই যাওয়া যায়। সেখানে আপনি সিনেমা দেখতে পারেন, খাবার খেতে পারেন, মুদি কেনাকাটা করতে পারেন, এমনকি পড়াশোনার জন্য নিরিবিলি জায়গাও খুঁজে পেতে পারেন। বছরের পর বছর ধরে এটি বিয়ের শুটিং এবং পুনর্মিলনীর কাজেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
মহামারির পর এখনো আগের মতো যাত্রী পরিবহন সক্ষমতায় পৌঁছাতে পারেনি বিমানবন্দরটি। তবে মানুষের কাছে এটি একটি নিছক ভ্রমণ কেন্দ্র না হয়ে আড্ডা ও বিনোদনের অন্যতম স্থান হয়ে উঠছে।
আধুনিকতা ও নান্দনিকতার মিশেল
আধুনিকতা ও নান্দনিকতার মিশেলে তৈরি চাঙ্গিকে বিশ্বের সেরা বিমানবন্দরের খেতাব দিয়েছে বিশ্বের বিমানবন্দরগুলোর র্যাংকিং ও রিভিউ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্কাইট্র্যাক্স।
স্কাইট্র্যাক্স বিশ্বের বিমানবন্দরগুলোর গ্রাহক সন্তুষ্টির ওপর বৃহত্তম বার্ষিক জরিপ পরিচালনা করে, যেখানে ভ্রমণকারীরা ৫৫০টিরও বেশি বিমানবন্দরের পরিষেবা এবং সুবিধা মূল্যায়ন করে থাকেন। চাঙ্গি স্কাইট্র্যাক্সের র্যাংঙ্কিংয়ে ১২ বার শীর্ষস্থান দখল করেছে, যার মধ্যে গত এক দশকেই ৮ বার বিমানবন্দরটি র্যাংকিংয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
গত ২ বছর দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং টোকিওর হানেদা বিমানবন্দরের কাছে শীর্ষস্থান হারানোর পর গত মার্চে বিমানবন্দরটি আবারও তার মুকুট পুনরুদ্ধার করে। 'অতুলনীয় যাত্রী অভিজ্ঞতার' জন্য চাঙ্গির প্রশংসা করেছে স্কাইট্র্যাক্স।
২০১৯ সালে করোনা মহামারির আগে চাঙ্গি বিমানবন্দর উড্ডয়ন ও অবতরণ মিলিয়ে ৩ লাখ ৮২ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করেছে, যেগুলো ৬ কোটি ৮০ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছে।
গার্ডেন, পার্ক ও অন্যান্য
চাঙ্গির অন্যান্য আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেইনফরেস্ট, হেজ মেজ (গোলকধাঁধা) এবং একটি ১২ মিটার উঁচু স্লাইড। আপনি যদি কোথাও যাওয়ার সময় বিমানবন্দরটিতে একটু আগে চলে আসেন, তাহলে সময় কাটানোর বহু অনুষঙ্গ পাবেন। ট্রানজিট লাউঞ্জে স্পা, বিনামূল্যে সিনেমা দেখা, সুইমিং পুল, ম্যাসাজ চেয়ার এবং প্রজাপতি বাগানে সময় কাটাতে পারেন।
বিমানবন্দরটিতে আরও আছে ক্যাকটাস গার্ডেন, বাউন্সিং নেট, ক্যানোপি পার্ক, ক্যানোপি ব্রিজ, ক্রিস্টাল গার্ডেন, ডিসমকভারি স্লাইড, ডিসকভারি গার্ডেন, এনচান্ডেট গার্ডেন, হেরিটেজ জোন, মিরর মেজ, পেটাল গার্ডেন, ইমারসিভ ওয়াল, কাইনেটিক রেইন, সিঙ্গাপুর রোজাক, স্টিল ইন ব্লুম, সূর্যমুখী বাগান, শাপলার বিলসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান।
টার্মিনাল ৪ এর বাইরে আছে এক মাইল দীর্ঘ লাইফ সাইজের ডাইনোসর প্রদর্শনী কেন্দ্র।
সিঙ্গাপুরবাসীদের মর্যাদার প্রতীক
স্কুল, স্থানীয় অভিনেতা থেকে শুরু করে সব বিষয়ে র্যাংকিংকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া সিঙ্গাপুরের জন্য চাঙ্গি বিমানবন্দরটি বিশেষ এক মর্যাদা বহন করে। বিশ্বের সেরা এই বিমানবন্দর নিয়ে সব সিঙ্গাপুরবাসীই গর্বিত।
সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ খুব কঠোরভাবে নিয়মিত এই র্যাংকিং পর্যবেক্ষণ করে। সুনাম ও যাত্রীদের পছন্দের শীর্ষে থাকায় বিমান সংস্থাগুলোও এখন চাঙ্গিকে ঘিরে আরও বড় পরিকল্পনা করছে।
যাত্রী অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বিমানবন্দরটির নিরাপত্তাও বিশ্বসেরা। ব্যস্ততম বিমানবন্দর হওয়া সত্ত্বেও যাত্রীদের লাগেজ হারানোর ঘটনা এখানে ঘটে না বললেই চলে। অনেক সময় যাত্রীরা কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করলেও চাঙ্গির দারুণ ব্যবস্থাপনার কারণে সেখানে এটিও সাধারণত ঘটে না।
বর্তমানে বিমানবন্দরের পঞ্চম টার্মিনালের নির্মাণ কাজ চলছে। আগামী দশকের মাঝামাঝিতে এটি চালু করার কথা রয়েছে।
দক্ষতা ও সৌজন্যতার দিক থেকে সিঙ্গাপুরের সুনাম আছে। চাঙ্গিতে তাদের সেই সুনামের প্রতিফলনই দেখা যায়।
তথ্যসূত্র: চাঙ্গিএয়ারপোর্ট.কম, বিবিসি
Comments