শীতে পোষা প্রাণীর যত্নে করণীয়

শীতকালে নিজের পাশাপাশি পোষা প্রাণীটির দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
শীতে পোষা প্রাণীর যত্ন
ছবি: সংগৃহীত

তীব্র শীত গৃহপালিত পশুপাখির জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। শীতকালে নিজের পাশাপাশি পোষা প্রাণীটির দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। চলুন জেনে নিই কীভাবে শীতকালীন অসুস্থতা থেকে পোষা প্রাণীদের মুক্ত রাখবেন।

পোষা প্রাণীকে ঘরের ভেতরে রাখা

ঠান্ডা থেকে পোষা প্রাণীদের নিরাপদ রাখার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো দিনের বেশির ভাগ সময় এবং সারারাত ঘরের ভেতরে রাখা। কুকুর বা বিড়ালের রাতে বাইরে বের হওয়ার প্রবণতা থাকে। তারা প্রায় সময়ই রাস্তার বেওয়ারিশ পশুগুলোর সংস্পর্শে গিয়ে নানা ধরনের জীবাণুবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে খুব বেশি সংবেদনশীল বিড়াল এবং কুকুরের ক্ষেত্রে হাইপোথার্মিয়ার ভয় থাকে।

তাই পোষা পশুপাখিদের রাতের পুরোটা সময় ঘরের ভেতরে রেখে দিনের কিছুটা সময় সঙ্গে নিয়ে বের হওয়া যেতে পারে শারীরিক অনুশীলনের জন্য। কারণ শীতের সময় দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা বা কিছু সময় হেঁটে বেড়ানো তাদের শরীর গরম রাখতে পারে।

 

থাকার জায়গা উষ্ণ রাখা

ঘরে উপযুক্ত উষ্ণতা না পেলে পোষা প্রাণীরা স্বাভাবিকভাবেই ঘরের ভেতর থাকতে চাইবে না। এ ছাড়া অনেক গৃহপালিত পশুপাখি আছে যাদের বাড়ির বাইরেই রাখতে হয়। এদের থাকার জায়গাটিকে শুষ্ক রাখতে হবে এবং এমনভাবে মজবুত ঘেরযুক্ত করে দিতে হবে যাতে এরা ভালোভাবে বসতে এবং শুতে পারে।

তাদের শরীরের তাপ ধরে রাখার জন্য ঘরটি যথেষ্ট ছোট হতে হবে। ঘরে মেঝে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উঁচু হবে এবং ছাদ খড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ঘরটি এমন স্থানে হতে হবে যেখানে বাতাসের ঝাপটা কম এবং সহজেই খাবার ও পানীয় পেতে পারে।

বাড়ির ঠান্ডা মেঝে থেকে পোষা প্রাণীদের বাঁচানোর জন্য গরম মাদুর বিছিয়ে দেওয়া ভালো উপায়। আর ঘুমানোর জায়গাটিতে দেওয়া যেতে পারে ছোট গরম বিছানা ও পশুদের জন্য নির্ধারিত কম্বল।

তবে খুব অল্প বয়স্ক অথবা অধিক বয়স্ক পশুগুলোর অতিরিক্ত গরম অনুভূত হতে পারে, তাই সতর্ক থাকতে হবে। এদের জন্য হিটিং প্যাড বেশ কাজে দিতে পারে। এগুলো মূলত প্রাণীদের জয়েন্টের ব্যথা হওয়া থেকে দূরে রাখে।

পোষা প্রাণীর শীতের পরিধেয়

পশুপাখিদের অধিকাংশেরই প্রকৃতি প্রদত্ত লোমের আবরণ থাকলেও এটি কখনোই মনে করা ঠিক নয় যে, তাদের ঠান্ডাতে কোনো সমস্যাই হবে না। পাতলা লোমযুক্ত পূর্ণ বয়স্ক পশু এমনকি অধিক লোমশ পশুগুলোর মধ্যে যারা বেশি সংবেদনশীল, তারা সঠিক সুরক্ষা ছাড়া বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে হাইপোথার্মিয়াতে আক্রান্ত হতে পারে। শরীরের বেশিরভাগ অংশকে ঢেকে রাখা সুন্দর একটি সোয়েটার দিতে পারে এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোমশ ছোট আকৃতির পশুগুলোর বেলায় এই পরিধেয়ের দরকার পড়ে না।

ঠান্ডার মধ্যে শীত থেকে আপনার আদরের পোষ্যটির পা বাঁচাতে এক জোড়া বুটি হতে পারে দারুণ একটি উপায়। বুটিগুলো পশুর থাবাগুলোকে ময়লা থেকে রক্ষা করে।

শরীরের উন্মুক্ত জায়গাগুলো পরিষ্কার রাখা

বাইরে থেকে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে নিজে পরিষ্কার হওয়ার পাশাপাশি পোষ্য প্রাণীটিকেও পরিষ্কার করা জরুরি।

ঠান্ডার সময় বাইরে ময়লা পায়ের আঙুলগুলোর মাঝে ঢুকে জ্বালা করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো জিহ্বা দিয়ে চাটতে দেখা যায় প্রাণীদের। এখানে ক্ষতিকর কোনো রাসায়নিক উপাদান থাকলে তা তাদের মুখে জ্বালা হওয়ার কারণ হতে পারে। তাই ঘরে ঢুকেই প্রথমে একটি আর্দ্র তোয়ালে দিয়ে পোষা প্রাণীটির পা মুছতে হবে।

এ ছাড়া কুয়াশায় পশম ভিজে দীর্ঘক্ষণ স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় রেখে দিলে শুষ্ক ত্বকসহ পোষা প্রাণীটির অন্যান্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় হালকা গরম পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে মৃদু শুকিয়ে পোষ্যটির শরীর মুছে দিয়ে শুকিয়ে নেওয়া উচিত।

সবচেয়ে ভালো বিকল্প হচ্ছে বুটি আর সোয়েটার থাকলে ব্যবহার করা। তাহলে পোষা প্রাণীদের কান, নাক, পা ও লেজ কুয়াশায় ভিজে যাওয়ার ভয় থাকবে না।

শীতে পোষা প্রাণীর ত্বকের যত্ন

ঠান্ডার তীব্রতা থেকে পোষা প্রাণীদের ত্বক বাঁচাতে ঘন ঘন গোসল করানো যাবে না। অতিরিক্ত আর্দ্রতার জন্য উপযুক্ত হচ্ছে খাদ্যে নারিকেল তেল ব্যবহার করা। শুধু পোষ্য পশু-পাখিদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি কিছু নিরাময় মলম আছে, সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়াও পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো প্রয়োগ করতে হয় নাক ও পায়ের আঙুলের আশেপাশে লাল দাগযুক্ত জায়গাতে।

ত্বকের যত্নে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শীতের সময় পশুগুলোর পশম বাড়তে দেওয়া। এটি প্রাকৃতিকভাবেই তাদের শরীরে উষ্ণতার একটি অতিরিক্ত স্তরের সংযোজন করে। তবে নষ্ট বা মরা পশম ঝরাতে প্রাণীদের শরীরে নিয়মিত ব্রাশ করতে হবে।

গাড়ি ছাড়ার সময় সতর্কতা

কুকুর বা বিড়ালকে প্রায়শই গাড়ির আশেপাশে আড়াল নিয়ে বসে থাকতে বা ঘুমাতে দেখা যায়। ইঞ্জিনের কারণে গাড়ি উত্তপ্ত থাকায় পশুগুলো সেই উষ্ণতা পোহাতে চায়। তাই গাড়ির ইঞ্জিন চালুর সময় আগেই চারপাশটা ভালো করে দেখে নিতে হবে। নতুবা মারাত্মক দুর্ঘটনার উপক্রম হতে পারে। দুর্ঘটনা এড়াতে গাড়ি ছাড়ার পূর্বে বোনেট, হুডের ওপর আঘাত করা এবং হর্ন বাজানো যেতে পারে।

শীতকালে পোষা প্রাণীর খাবার

শীতের মাসগুলোতে যেকোনো প্রাণীর দেহ অন্যান্য সময়ের চেয়ে দ্রুত শক্তি ক্ষয় হয়, যা পুষিয়ে নিতে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত খাবারের। এ ছাড়া ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ সঠিক খাবার পশুগুলোর পশমের সঠিক বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। আর এ সময় ঘন পশম মানেই উষ্ণতা ধরে রাখার উপযোগী স্বাস্থ্যকর ত্বক।

তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, পোষ্য প্রাণীটির শরীরের ওজন যেন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে না যায়। অনেক ক্ষেত্রে দুয়েক পাউন্ডও ওজন বাড়াও পশুর জন্য স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সুষম খাবার যোগান দেওয়ার পাশাপাশি খাবারের তাপমাত্রা ধরে রাখতে কিছু গরম পানি মেশানো যেতে পারে। তবে পোষা পশুপাখিদের খাবারগুলো অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে গরম করা উচিত। কারণ খাবার সমানভাবে গরম না হলে খাবারের নির্দিষ্ট কোনো অংশে মুখ লেগে প্রাণীদের মুখ পুড়ে যেতে পারে।

গরম পানির ব্যবস্থা রাখা

যেসব পশুপাখি দ্রুত ক্যালরি খরচ করে, শীতকালে তাদের শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। এ সময় শুষ্ক বাতাস পোষা প্রাণীদের তৃষ্ণা বাড়ায়। তাই পোষা পশুপাখিদের পানির পাত্রগুলো সবসময় পূর্ণ রাখা জরুরি। এক্ষেত্রে চওড়া পাত্রের পরিবর্তে গভীর পাত্র ব্যবহার করতে হবে এবং দিনে দুইবার কুসুম গরম পানি পাল্টে দিতে হবে।

সাধারণত ছোট বাটিগুলো দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়। তাই বড় প্লাস্টিকের বাটি গরম করে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাটিটি গরম রাখার জন্য পোষা প্রাণীদের গরম বিছানার কাছাকাছি রাখা ভালো।

হাইপোথার্মিয়ার বিষয়ে সর্তক থাকা

শীতে পোষা প্রাণীদের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি হচ্ছে হাইপোথার্মিয়া। এই রোগের লক্ষণগুলো হলো-

ঘন ঘন তন্দ্রা, কাঁপুনি, দ্রুত হৃদস্পন্দন, ফ্যাকাশে মাড়ি, চোখের মণির কালো অংশ বড় হয়ে যাওয়া এবং চেতনা হ্রাস পাওয়া।

এই লক্ষণগুলোর যে কোনোটি দেখা দিলে দ্রুত পশু চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। বিশেষজ্ঞের নির্দেশনা পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাৎক্ষণিকভাবে আক্রান্ত পোষ্যটিকে একটি উষ্ণ জায়গায় রাখা যেতে পারে।

শীতের রাসায়নিক দ্রব্য তাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রাখা

প্রচণ্ড শীতের সময়ে প্রায় বাসায় বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিফ্রিজ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলো পশুপাখিদের কিডনির কার্যকারিতা এবং স্নায়বিক অবস্থাকে ব্যাহত করে।

এগুলোর মধ্যে ইথিলিন গ্লাইকোল বিশেষ করে কুকুর এবং বিড়ালের জন্য ক্ষতিকর। পশুগুলো প্রায়ই এর মিষ্টি স্বাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। রাসায়নিক বস্তুর কন্টেইনারগুলো খোলা থাকলে অথবা যেকোনোভাবে অ্যান্টিফ্রিজ সামগ্রী মেঝেতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন কুকুর বা বিড়াল এগুলোতে সরাসরি মুখ দিতে পারে বা পা ভেজানোর পর তা চেটে খেতে পারে। তাই কোনোভাবেই যেন এরকম অবস্থার সৃষ্টি না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।

প্রাথমিক চিকিৎসার কিট রাখা

শীতকালে পোষা পশুপাখিদের নিয়মিত যত্নের পাশাপাশি সেরা সংযোজন হতে পারে বাড়িতে এদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসার কিট রাখা। আর ঠান্ডার এই সময়টাতে আপনার আদরের পোষ্যটির যেকোনো জরুরি অবস্থায় সঠিক থেরাপি বা ওষুধের জন্য একজন অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

শীতল আবহাওয়াতে একটি মানব শিশুর যত্ন নেওয়ার মতো পোষা প্রাণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায়ও উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এই সচেনতামূলক ব্যবস্থার ভেতরে রয়েছে তাদের যথাযথ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ, উপযুক্ত থাকার জায়গা ও পরিধেয় এবং ত্বকের যত্নসহ অন্যান্য সতর্কতা।

 

Comments