বন্যায় ভাসমান টয়লেট

ভাসমান টয়লেট
ছবি: সংগৃহীত

এ বছরের বন্যাটা হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে। ঐতিহাসিকভাবে সেপ্টেম্বর মাসে যে বন্যাগুলো হয় সেগুলোর পানি খুব দ্রুত নেমে যায় নানা ভৌগলিক ও জলবায়ুগত কারণে। লা-নিনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ বছর ক্লাউড ব্রার্স্ট বা মেঘ বিস্ফোরণ ঘটেছে। এর ফলে ঘটা ভয়াবহ বন্যাটির পেছনে যে রাজনৈতিক উপাদান অনুপস্থিত তা বলার উপায় নেই, তবে বন্যাটি যে ঘটতেই যাচ্ছে সেটা এ বছরের মে মাসেই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল।

সেই কারণে আমরা তখন থেকেই এই বন্যা মোকাবিলার প্রযুক্তি নিয়ে প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করি। দুর্যোগ ও বন্যা মোকাবিলায় কী ধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা দরকার যা মানুষের জীবনকে সহজ করে দেবে তা নিয়ে চিন্তা, গবেষণা, ডিজাইন প্রণয়ন করতে থাকি। এরইমধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনটি হয়ে গেল এবং জলবায়ুগত কারণে বন্যাটি ২০ দিন দেরিতে শুরু হলো।

শুরুতেই যখন ত্রাণ নিয়ে দুর্গত এলাকায় কাজ শুরু হলো তখন দুর্গত ও স্বেচ্ছাসেবী দল উভয়েই হঠাৎ বেড়ে যাওয়া পানিতে পরিবহন সংকটে পড়লেন। অতি দ্রুত দুর্গত এলাকায় আমরা ভেলা ও নৌকা তৈরি করে পাঠালাম। এটা সম্ভব হয়েছিল আমাদের পূর্ব প্রস্তুতির কারণে। কিছুদিনের মধ্যেই ফেনী ও নোয়াখালী থেকে পানি নেমে যেতে শুরু করল। নেমে যাওয়া পানিতে দেখা গেল বাড়ি ও টয়লেটগুলো বিধ্বস্ত, বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ।

টয়লেট বিধ্বস্ত হওয়াতে পুরুষরা কোনোরকমে কাজ চালিয়ে নিলেও নারীরা প্রতিদিন অন্ধকার নামলে প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করতে পারলেন। বিশুদ্ধ পানির টিউবয়েলগুলোতে বন্যার দূষিত পানি ঢুকে যাওয়ায় অকার্যকর হয়ে গেল, সাবমারসিবল পাম্পগুলো বিদ্যুৎ না থাকার কারণে কাজ করল না।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ না থাকায় আরেকটি সমস্যা হলো। বিপদগ্রস্ত মানুষ তাদের যোগাযোগের যন্ত্রগুলো চার্জ করতে পারছে না। এরসঙ্গে যুক্ত হলো মোবাইল নেটওয়ার্কের অনুপস্থিতি। যেসব জায়গায় ফোরজি নেটওয়ার্ক চালু ছিল সেসব জায়গায় দেখা গেল প্রাগৈতিহাসিক টু-জি নেটওয়ার্ক চলছে, যা দিয়ে পরিবারগুলো নিকটবর্তী স্বেচ্ছাসেবক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না, জানাতে পারছিল না যে তাদের সাহায্য দরকার। এইসব সমস্যার সমাধান করার জন্য আমরা ধীরে ধীরে প্রযুক্তির সহায়তা দিতে শুরু করলাম।

প্রথমত, এক ধরনের ভাসমান টয়লেট নির্মাণ করা হলো যা বন্যার পানিতে ভেসে থাকবে, পানি চলে গেলে মাটিতে বসে পড়বে, আবার বন্যার পানি আসলে ভেসে উঠবে। উভয় অবস্থাতেই এটি কার্যকর থাকবে। এই টয়লেটের সবচেয়ে মজার বৈশিষ্ট্য হলো, এতে কেমিক্যাল, সিভিল, মেকানিক্যাল ও ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সমন্বয়ে একটি মাইক্রো পয়ো-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিট স্থাপন করা হলো। যা আধা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পরিচালিত হয় এবং পরিবেশে কোনো ধরনের ক্ষতিকর বর্জ্য ছড়াতে দেয় না। একটা পাটাতনে দুটো টয়লেট আছে, যার একটি নারীর জন্য সংরক্ষিত, অন্যটি সবার।

নিরাপদ পানির জন্য আমরা একটি ফিল্টার তৈরি করলাম। যা আশেপাশে থাকা বন্যার পানিকে একটি রিজার্ভারে নিয়ে ভাসমান বর্জ্য, জীবাণু ও দুর্গন্ধমুক্ত করে বিশুদ্ধ করে দেয়। সৌরবিদ্যুতে পরিচালিত এই সিস্টেমটি টানা ৬ মাস ৫০০ পরিবারের সুপেয় পানি সরবরাহ করবে। এটি সহজে স্থানান্তর ও তত্ত্বাবধানযোগ্য। 

বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যার সমাধান করার জন্য আমরা জুলস আর্ক নামে (JUL's ARK) একটি নতুন ধরনের ডিভাইস তৈরি করি। যা থেকে সব ধরনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস শোনার ও অডিও বিনোদনের ব্যবস্থা আছে, বাসায় ব্যবহৃত বহনযোগ্য সব ধরনের ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি (AC ও DC) চালানো যায়, কমপক্ষে ৫০ জন মানুষের স্মার্টফোন চার্জ করা যায়, ১০ ঘণ্টা আলো জ্বলে, ল্যাপটপ, ৩০ বার ডিএসএলআর ক্যামেরা চার্জ করা যাবে। ৬ ঘণ্টা এলসিডি টেলিভিশন চলবে। সঙ্গে থাকা বিল্ট ইন ফোর জি বুস্টার অ্যান্টেনার সাহায্যে দুর্বল নেটওয়ার্ককে ফোরজি করার মাধ্যমে অডিও ভিডিও কল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব ব্যবহার করা যায়। এই যন্ত্র ব্যবহার করে যোগাযোগের সুবিধার কারণে দুর্গত এলাকায় দ্রুত সাহায্য পৌঁছানো সম্ভব হয়।

আমাদের তৈরি করা ভেলা ও নৌকাগুলো এখনো পর্যন্ত নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের স্বেচ্ছাসেবীরা ব্যবহার করছেন। নির্মিত টয়লেট ও পানির ফিল্টারটি ৮ সেপ্টেম্বর বন্যাপ্রবণ কুড়িগ্রামের চর এলাকায় স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া জুলস আর্ক যন্ত্রটির বেশ চাহিদা তৈরি হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে আরো প্রায় পঞ্চাশটির নির্মাণ কাজে হাত দিচ্ছি।

এ কাজটি বাস্তবায়ন করেছে শালবৃক্ষ লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট টেকনোলজি এডুকেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিয়রশিপ (CTTE)। কাজগুলোতে স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। এতে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শালবৃক্ষ লিমিটেড, আজিমুর রোকিয়া রহমান ট্রাস্ট ও বহু বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীরা।

Comments

The Daily Star  | English
education in Bangladesh

As a nation, we are not focused on education

We have had so many reform commissions, but none on education, reflecting our own sense of priority.

13h ago