অফিস ক্যান্টিন: খাবারের সঙ্গে স্মৃতিও তৈরি হয় যেখানে

অফিস ক্যান্টিন
ছবি: প্রবীর দাশ

আমাদের ধানমন্ডির অফিসটা আশির দশকে একটি সাধারণ দোতলা বাড়ি ছিল। যেখানে ছাঁটাই করা ঘাসের লন ছিল, আলাদা একটি ভবনে ছিল রান্নাঘরসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজের স্থান।

নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে যখন দৃষ্টিনন্দন এই বাড়িটি আমাদের কাছে অফিস হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয় তখন রান্নাঘর অংশের এক কোণায় ক্যান্টিন তৈরি করা হয়। যেখানে কেবল শিঙাড়া আর চা পরিবেশন করা হতো।

যে ছেলেটি আমাদের চা পরিবেশন করত, ওর ছিল অ্যাথলেট বা ব্যায়ামবিদের মতো বৈশিষ্ট্য। ধোঁয়াওঠা চায়ের কাপ ভর্তি ট্রে নিয়ে যখন ও সিঁড়ি দিয়ে নামত, মনে হতো যেন এক দক্ষ দড়াবাজিকর। এক্ষেত্রে সে যেমন তার কলাকৌশল দেখাতে পছন্দ করত, আমরাও তেমনি তাদের কাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলাম।

অফিস ক্যান্টিনগুলো ছোট বা অপরিচ্ছন্ন যাই হোক না কেন, অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো কর্মীদের জীবনে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিশেষ করে সেসব এলাকায় অফিসে কাজের ফাঁকে ক্ষুধা মেটানোর জন্য আশপাশে কোনো রেস্তোরাঁ বা খাবার দোকান নেই।

ক্যান্টিন
ছবি: সংগৃহীত

ব্যস্ত শহরগুলোতে অফিসগামীরা সাধারণত দুপুরে খাবারের জন্য নিজেদের মতো করে পরিকল্পনা করে নেন। কেউ হয়তো বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসেন, কেউ রেস্তোরাঁ থেকে কিনে আনেন, আবার কেউ ক্যান্টিনের খাবার খান। কেউ কেউ তো দুপুরের খাবারই খান না।

সাধারণত যেসব অফিসে ১০০ থেকে ৫০০ কর্মী কাজ করেন সেখানে উদ্ধারকর্তা হয়ে আসে অফিস ক্যান্টিন। যেগুলো ‍মূলত সাবিসিডি বা ভর্তুকি দিয়ে চালানো হয়। কোনো কোনো ক্যান্টিনে সকালের হালকা স্ন্যাক্স, দুপুরের খাবার এবং মৌসুমি ফলের জন্য মাস হিসেবে টাকা নেওয়া হয়। আবার কোথাও কোথাও আগে টাকা দিয়ে তারপর খাবার নিতে হয়।

অফিসের ক্যান্টিনগুলো সাধারণত প্রশাসনের নজরদারিতে থাকে, যেন গুণমান বজায় থাকে এবং খাবার যথাযথ স্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি করা হয়। এসব ক্যান্টিনে নিয়োগ দেওয়া হয় পেশাদার বাবুর্চি ও রন্ধনবিদ।

ক্যান্টিন ছাড়াও অফিসগুলোর প্রতি ফ্লোরে থাকে চায়ের জন্য বিশেষায়িত কর্নার, যা হয় গোটা অফিসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। সেখানে সাজানো থাকে বিভিন্ন ধরনের চায়ের কাপ ও মগ, যেগুলোয় লেখা থাকে নানা ধরনের উক্তি। থাকে বিভিন্ন স্বাদের চা ও কফির সম্ভার।

ধোঁয়া ওঠা চা বা কফির গন্ধ দারুণ উদ্দীপনা জোগায়। আর যদি কোথাও থাকে ফ্রেঞ্চ প্রেস কফি, তাহলে তো কথাই নেই। যদিও বেশিরভাগ অফিসে কফি মেশিন থাকে, যেখান থেকে ডাবল লাতে বা দুটো টিব্যাগ দিয়ে দুধ চা খাওয়ার প্রচলনই বেশি থাকে।

ঢাকার বেশিরভাগ অফিসের ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার ও বিকেলের নাশতাই মূলত পরিবেশন করা হয়। অবশ্য পত্রিকা অফিসগুলোর ক্যান্টিন মধ্যরাত পর্যন্ত সচল থাকে। তাদের হালকা নাশতার মেন্যুতেও থাকে পত্রিকার প্রথম পাতার মতো বৈচিত্র্য।

সেখানে পাবেন ডিম-পরোটা রোল, আলু আর সবজির কাটলেট, ফুলকো আলু পুরির সঙ্গে তেঁতুলের চাটনি, চিকেন ফ্রাই এবং সবার পছন্দের নুডলস, সঙ্গে কাঁচামরিচ আর অনেক সবজি।

দুপুরে যেদিন বিশেষ খাবার রান্না হয় সেদিন থাকে ইলিশ পোলাও, গরুর মাংসের তেহারি, টমেটোর ঝোলে ভেটকি আর পাঁচমিশালি সবজির লাবড়া, যার স্বাদ অমৃতের মতো।  এই চমৎকার সুস্বাদু সব খাবার যদি ভর্তুকি দামে মেলে, তাহলে আর কী চাই?

একজন চাকরিজীবী হিসেবে প্রতিদিন বাইরে বা রেস্তোরাঁয় খাবার খাওয়া সম্ভব না। এটি শুধু স্বাস্থ্যের জন্যই যে খারাপ তাই নয়, মানিব্যাগের জন্যও ক্ষতিকর! তারপরও অনেক কর্মজীবী মানুষই অফিসে খাবার বহন করে নিয়ে যেতে চান না।

এটা ঠিক যে, প্রতিদিন ক্যান্টিনের খাবার খাওয়া আপনার হজম প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বিশেষ করে যখন দিনশেষে খেতে যান আর সবুজ শাককে দেখতে পান কালো হয়ে যেতে কিংবা মাছটা হয়তো গন্ধ হয়ে যায়। অনেক ক্যান্টিনে দেখবেন এত তেল দিয়ে রান্না করে যে মনে হয় সেই তেল-ঝোলে সাঁতার কাটছে গরুর মাংসগুলো।

তবে যেমন খাবারই রান্না করুক না কেন, অফিস ক্যান্টিন সবারই প্রিয় স্থান। যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে রাজনৈতিক বিতর্ক করা যায়, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা যায় এবং কাপের পর কাপ চা আর ভাজাপোড়া খেতে খেতে ব্যক্তিগত নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলা যায়। এজন্যই মধ্যাহ্নভোজ আর চায়ের বিরতি এখনও আমাদের অফিস জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সময়।

বলাই বাহুল্য যে, ক্যান্টিন আর চায়ের কর্নারের মালিকানা অফিসের চেয়ে বেশি কর্মীর। যেখানে থাকা টেলিভিশনে সবসময়ই কোনো না কোনো খেলা চলে। সহকর্মীরা সেই টেলিভিশন ঘিরে খেলা উপভোগ করেন, নিজের দলের জন্য উল্লাস প্রকাশ করেন।

ফুটবল ম্যাচ চলাকালে এমনকি ক্যান্টিনের কর্মীরাও অফিসের অন্যদের মতো প্রিয় দলের জার্সি পরে আসেন এবং অন্য সবার মতো খেলা নিয়ে বাজি ধরেন। এ সময় সহকর্মীদের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়। এটা হলো অফিসের একমাত্র জায়গা যেখানে আপনি সব বিভাগের কর্মীদের একসঙ্গে পাবেন, তাদের গল্প শুনতে পারবেন, খাবার ভাগ করে নিতে পারবেন, বন্ধুর মতো সহকর্মীদের সঙ্গে বসে গল্প করতে পারবেন।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

JnU students vow to stay on streets until demands met

Jagannath University (JnU) students tonight declared that they would not leave the streets until their three-point demand is fulfilled

4h ago