ঢাকার পিঠা বিক্রেতা নারীদের গল্প

ঢাকার পিঠা বিক্রেতা নারীদের গল্প
ছবি: আয়মান আনিকা

ঢাকায় শীত নেমে এলে আরামদায়ক ঠান্ডা আবহাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসে গরম গরম পিঠার ঘ্রাণ। রাস্তার মোড়ে, বাজারে কিংবা ব্যস্ত গলিপথে দেখা মেলে পিঠা বিক্রেতা নারীদের। ঝুড়িভর্তি ধোঁয়াওঠা ভাপা, পাটিসাপটা কিংবা চিতই পিঠা নিয়ে যারা বসে থাকেন ক্রেতার অপেক্ষায়।

তাদের হাতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী এসব পিঠার স্বাদ নেওয়ার জন্য প্রায়ই তো চলার পথে বিরতি দিই আমরা। কিন্তু যে হাত দিয়ে এসব চমৎকার পিঠা তৈরি হয় তার খোঁজই বা কতজন রাখি?

বেঁচে থাকার গল্প

গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডের পাশে প্রতিদিন সন্ধ্যা নামতেই পিঠার ছোট্ট দোকান নিয়ে বসেন সুফিয়া বেগম। যতই শীত পড়ুক,তার হাতের কাজ বন্ধ হয় না।

কিছুটা নিচু কিন্তু দৃঢ় স্বরে সুফিয়া বলেন, 'আমি প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠি। ঠান্ডা কিংবা ক্ষুধা কারো জন্যই অপেক্ষা করে না।'

সুফিয়া এবং তার মতো অসংখ্য নারীর জন্য ঢাকায় পিঠা বিক্রি কোনো মৌসুমি উৎসব নয়, বরং তাদের বেঁচে থাকার উৎস।

সুফিয়া জানালেন, হঠাৎ করেই তার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসা করতে গিয়ে শেষ হয়ে যায় সমস্ত সঞ্চয়। এরপর মায়ের কাছ থেকে শেখা পিঠা তৈরির বিদ্যা কাজে লাগাতে নেমে পড়েন তিনি। সাধারণ কিছু উপকরণে তৈরি মজাদার পিঠা শীতের দিতে খেতে যেমন মজা লাগে, মনকেও যেন উষ্ণ করে।

এই শহরের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সুফিয়ারা পিঠা তৈরির জন্য অপরিহার্য হলেও, কোলাহলপূর্ণ নগরীতে তারা অনেকটাই যেন অদৃশ্য। তারা যেন থেকেও কোথাও নেই।

পিঠা তৈরির যে শৈলী, তা যেন শীতকালের মতোই পুরোনো। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশের নারীরা নিপুণ হাতে তৈরি করে আসছেন নানা ধরনের পিঠা। কিছুটা চালের গুঁড়া, সামান্য গুড় আর তার সঙ্গে যোগ করেন এক জীবন পরিমাণ ধৈর্য। তাতেই তৈরি হয় মজাদার পিঠা।

পিঠা
ছবি: আয়মান আনিকা

ঢাকার এই পিঠা বিক্রেতা নারীরা কেবল বেঁচে থাকার তাগিদেই তৈরি করে যান পিঠার পর পিঠা। ঐতিহ্য তাদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।

তিন সন্তানের মা ৩৫ বছর বয়সী জামিলার জন্য পিঠা তৈরি হলো সময় এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রতিদিন সকালে উঠে যুদ্ধ করে যাওয়া। একটি ব্যস্ত বাসস্ট্যান্ডের ধারে বসে তিনি পিঠা তৈরি করে বিক্রি করেন। তাকে লড়াই করতে হয় তীব্র গাড়ির হর্ন আর ভিড়ের সঙ্গেও।

জামিলা বলেন, 'কোনো কোনো দিন সব পিঠা বিক্রি হয়ে যায়। আবার কোনো দিন এমনও হয় যে অর্ধেক সামগ্রী বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে হয়। কিন্তু আমি পিঠা তৈরি বন্ধ করে দিতে পারি না। কারণ আমি কাজ বন্ধ করলে বাড়িভাড়া দিতে পারব না, সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারব না।'

যখন কথা বলছিলেন, তখনও তীক্ষ্ণ চোখে ভিড়ের মধ্যে পিঠার ক্রেতা খুঁজছিলেন তিনি।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চালের আটার দাম, চুলা জ্বালাতে ব্যবহৃত কাঠের দামও। সেইসঙ্গে শহরে টিকে থাকার প্রতিযোগিতাও হয়েছে কঠোর। পিঠার দামও খুব বেশি নয়। তারপরেও কিছু ক্রেতা দামাদামি করতে থাকেন।

আমাদের এই নারীরা কেবল পিঠাই তৈরি করেন না, তাদের কাঁধে থাকে নানান ধরনের দায়িত্বও। শিশুপালন থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় কাজও তাদের সামাল দিতে হয়। এক কথায় বলা যায়, নিজের কাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে করতেই দিন কেটে যায় তাদের।

শাহজাদপুরের ঝিল পাড়ে পিঠা বিক্রি করেন শাহানা।

তিনি বলেন, 'অনেক আগেই স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তখন বেঁচে থাকার তাগিদে, সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য আমাকে বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজে নিতেই হয়েছে। পিঠা তৈরি আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছে। আমি এখন সপ্তাহে সাতদিন কাজ করি। একেবারে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত।'

কাজ করতে করতে প্রায় সময়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েন এই নারীরা। তাদের হাত আর মুখে দেখা দেয় ক্লান্তির ছাপ। তবু তারা থেমে যান না। বরং পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য, সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার আশায় নতুন উদ্যমে কাজে নামেন তারা।

ঐতিহ্য যখন ভবিষ্যত নির্মাণ করে

পিঠা তৈরি অনেক নারীর জন্য কেবল মৌসুমি ব্যবসা নয়, এটা সেই সব নারীর জন্য স্বাবলম্বী হওয়ার পথ যারা কখনো হাল ছেড়ে দেন না। কিছু নারী আছেন যারা পিঠা বিক্রির মাধ্যমে নিজের নৈপুণ্য প্রদর্শনের সুযোগ খুঁজে পান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিংবা স্থানীয়ভাবে পরিচিতিদের মধ্যে পিঠা বিক্রি করেও তারা নিজের পরিচয় তৈরি করতে চেষ্টা করেন।

রাস্তার এক কোনায় বসেই সাধারণত পিঠা বিক্রি করতেন সাহানা। তবে ইদানিং অর্ডারের ভিত্তিতে বাড়ি বাড়ি পিঠাও পাঠাচ্ছেন। আর এ কাজে সাহায্য করছে তার বড় মেয়ে।

ফেসবুক কীভাবে ব্যবহার করতে হয় জানতেন না জানিয়ে কিছুটা হেসে শাহানা বলেন, 'আমার মেয়ে শিখিয়েছে। এখন অনেকেই আমাকে পিঠার জন্য মেসেজ পাঠান। তারা প্রশংসা করেন। কেউ প্রশংসা করলে তো ভালোই লাগে।'

চলুন, মনে মনে শপথ করি। এই শীতে প্রতিবার আমরা যখন তাজা আর উষ্ণ পিঠার স্বাদ উপভোগ করব তখন পিঠা তৈরিকারী এই নারীদের ধন্যবাদ জানাব। তাদের প্রশংসা করব। যারা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন, যারা নিজের হাতে প্রতিদিন তৈরি করে যান মজার মজার পিঠা, একই সঙ্গে যারা লড়াই করেন সমাজে দৃশ্যমান হওয়ার জন্য, টিকে থাকার জন্য।

পরের বার যখন পিঠার স্বাদ নেবেন, তৈরিকারী নারীর নামটা জেনে নেবেন। তার চোখের দিকে তাকাবেন, মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখবেন; খেয়াল করে দেখবেন ওই চোখের পেছনে আছে এক বিশ্ব সমান সাহস। যে সাহসের খোঁজ পেলে সবারই ভালো লাগবে।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

Hamza scores on home debut as Bangladesh beat Bhutan 2-0

Bangladesh's star midfielder Hamza Choudhury found the net as the men in red and green secured a 2-0 win over Bhutan in a FIFA friendly at the National Stadium in Dhaka on Wednesday. 

32m ago