সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চুঙ্গা পিঠা

চুঙ্গা পিঠা
চলছে চুঙ্গা পিঠা বানানো। ছবি: স্টার

ঢলু বাঁশ, নতুন বিন্নি চাল, কলাপাতা আর খড়। এই চার উপকরণ হাতের কাছে থাকলেই সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চুঙ্গা পিঠা বা চুঙ্গাপুড়া বানানোর জন্য আপনি প্রস্তুত।

কয়েক দশক আগেও অগ্রহায়ণ-পৌষে শীতের আগমনী উদযাপনে চুঙ্গা পিঠার উৎসবে মেতে উঠত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা সিলেট ও মৌলভীবাজারের গ্রামাঞ্চল।

তবে প্রস্তুত প্রক্রিয়ার জটিলতা, অনাগ্রহ আর ঢলু বাঁশের সংকটে চুঙ্গা পিঠার গৌরবোজ্জ্বল অতীত এখন অনেকটাই ম্লান। যদিও একেবারে হারিয়ে যায়নি। বরং চুঙ্গা পিঠার চাহিদা তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য খুলেছে নতুন দিগন্ত।

ঠিক কবে থেকে সিলেট ও মৌলভীবাজারে চুঙ্গা পিঠা বানানো শুরু হয়েছে সে সম্পর্কিত সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও, এ পিঠা মূলত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর হাত ধরে সিলেট ও মৌলভীবাজারে জনপ্রিয়তা পায় বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

সিলেট ও মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় 'ঢলু' নামের এক প্রজাতির বাঁশ হয়, যার বৈজ্ঞানিক নাম Schizostachyum dullooa। এই ঢলু বাঁশই চুঙ্গা পিঠার মূল অনুষঙ্গ।

সম্প্রতি সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জের রসুলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামীণ পরিবেশে চুঙ্গা পিঠা প্রস্তুতের ব্যাপক আয়োজন। জানা যায় এই পিঠা বানানোর পদ্ধতি।

সিলেট
ছবি: স্টার

চুঙ্গা পিঠা তৈরি করার জন্য লম্বাটে এই বাঁশের একদিকে গাট রেখে অন্য গাটের ঠিক আগে কেটে রাখা হয়। তারপর কলাপাতা কেটে প্যাঁচালোভাবে বাঁশের ভেতরে ঢোকানো হয়। তারপর এরমধ্যে আগে থেকে ভিজিয়ে রাখা আমন মৌসুমে উঠানো নতুন বিন্নি চাল ভরা হয়। প্যাঁচানো কলাপাতা বাঁশের ভেতরে একটা গোল স্তর তৈরি করে, যার ফলে চাল বাঁশের গায়ে না গেলে কলাপাতার মোড়কের মধ্যে থাকে।

বিন্নি চাল ভরা হয়ে গেলে খড় দিয়ে বাঁশের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর গর্ত করে দুইপাশে কলাগাছ রেখে তার ওপর আড়াআড়িভাবে বাঁশ রেখে ওপরে নিচে খড় দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এই ঢলু বাঁশ আগুনে একেবারে পুড়ে যায় না। বরং এ থেকে এক ধরনের তরল পদার্থ নির্গত হয়, যা দিয়ে ভেতরের বিন্নি চাল সুন্দরভাবে সেদ্ধ হয়ে পিঠা হয়।

৪০ থেকে ৫০ মিনিট পোড়ানোর পর বাঁশ কেটে কলাপাতায় মোড়ানো পিঠা বের করা হয়। টাটকা গরম কিংবা সংরক্ষণ করে ঠান্ডা করেও এই পিঠা পরিবেশন করা হয়।

মূলত শীতের শুরুতে সিলেট ও মৌলভীবাজারের নদী, বিল ও খালের পানি কমে আসায় মাছ ধরা পড়ে। এ সময় বিভিন্ন এলাকায় মাছের মেলাও বসে। সেসব মাছ ভাজা কিংবা ভুনার সঙ্গে চুঙ্গা পিঠা খাওয়া দীর্ঘদিনের প্রথা।

তবে শুধু মাছ নয়, মাংস ভুনা, শাক ও মাছের ভর্তা, নতুন চালের পায়েস, দুধ, নারকেল ইত্যাদি নানা কিছুর সঙ্গে চুঙ্গা পিঠা পরিবেশন করা যায়।

'চুঙ্গা' শব্দটি বাংলা 'চোঙ' বা 'চোঙা' শব্দের একটি আঞ্চলিক রূপ, যার অর্থ হচ্ছে 'নল'। এই পিঠা বাঁশের ভেতরে বানানো হয় বলে এর আকৃতি নলের মতো হয় বলেই স্থানীয়ভাবে এই নামটি প্রচলিত হয়েছে।

সিলেট ও মৌলভীবাজারে চুঙ্গা পিঠার প্রচলন কমে যাওয়ার পেছনে দায়ী ঢলু বাঁশের অপর্যাপ্ততা। এ অঞ্চলের পাহাড়ে খুব দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এ জাতের বাঁশ।

এ অঞ্চলের স্থানীয় বাজারে পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা ঢলু বাঁশ প্রতি আঁটি (২০ খণ্ড) বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়, যার মূল্য এক দশক আগেও ১০০ টাকার ভেতর ছিল। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পৌষ সংক্রান্তির সময় এ দাম আরও বেড়ে যায়।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ঢলু বাঁশ বিক্রেতা হীরা দাশ বলেন, 'আগে দিনে ১০-১৫ আঁটি বাঁশ পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা যেত। এখন ঢলু বাঁশ এতটাই কমে গেছে যে সারাদিনে ২ বা ৩ আঁটি বাঁশ সংগ্রহ করা যায়।'

নগর জীবনে চুঙ্গা পিঠা প্রস্তুতের সময় না থাকলেও এখনও এটির চাহিদা আছে ব্যাপক পরিসরে। বিশেষ করে বিভিন্ন সামাজিক উৎসব ও অতিথি আপ্যায়নে অনেকেই চুঙ্গা পিঠার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চান।

আর সিলেটের ঐতিহ্যকে ধারণ করে গত ৩ বছর ধরে অনলাইনে 'সাউদা'স কিচেন' পেজের মাধ্যমে চুঙ্গা পিঠা বিক্রি করছেন সিলেটের দুই তরুণ উদ্যোক্তা বোন সাউদা আক্তার চৌধুরী ও শামীমা ইয়াসমিন চৌধুরী।

সাউদা আক্তার চৌধুরী বলেন, 'চুঙ্গা পিঠা সবার পছন্দ, কিন্তু কষ্ট করে বানিয়ে খেতে পারেন না অনেকেই। আমাদের গ্রামে চুঙ্গা পিঠা বানানোর ঐতিহ্য ও ব্যবস্থা এখনও আছে। তাই এই সুযোগটা আমরা নিয়েছি। সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশে বানানোর পর তা সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে।'

শামীমা ইয়াসমিন চৌধুরী বলেন, 'প্রতিটি অঞ্চলেরই ঐতিহ্যবাহী খাবার আছে, আর আমাদের সিলেটের মধ্যে চুঙ্গা পিঠা ঐতিহ্যবাহী। চুঙ্গা পিঠা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আগে গ্রামে গ্রামে করা হতো কিন্তু বর্তমানে আর করা হয় না। আমাদের গ্রাহকরা চুঙ্গা পিঠা খেয়ে পুরোনো সেই ঐতিহ্যের স্বাদ পাচ্ছেন। তবে ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে চাহিদা অনুযায়ী পিঠা আমরা সরবরাহ করতে পারি না।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Child rape cases rise nearly 75% in 7 months

Child rape cases in Bangladesh have surged by nearly 75 percent in the first seven months of 2025 compared to the same period last year, according to data from Ain o Salish Kendra (ASK).

2h ago