আড়ংয়ে সামিউল আলমের ৪৪ ফুট দীর্ঘ নকশিকাঁথার গল্প

ঢাকার ধানমন্ডিতে সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া আড়ংয়ে দেখা যাচ্ছে ৪৪ ফুট লম্বা একটি নকশিকাঁথা, যার নাম মহাআড়ঙ্গ। সামিউল আলমের নকশা করা এই কাঁথায় সম্মিলন ঘটেছে ঐতিহ্য, স্থায়ীত্ব আর উদ্ভাবনের। এই শিল্পকর্মে ফুটে উঠেছে পুরোনো কাপড়ের নতুন ব্যবহারের এক নান্দনিক রূপ, এই আধুনিক বিশ্বে যেখানে সংরক্ষিত হয়েছে দেশি ঐতিহ্য।
বর্তমান বিশ্ব দ্রুত শিল্পায়নের আর বিপুল পরিমাণ পণ্য উৎপাদন সক্ষমতার। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের টিকে থাকা এটাই প্রমাণ করে যে, এই শিল্প কতটা স্থিতিস্থাপক। ঐতিহ্যবাহী পণ্য নকশিকাঁথা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে মহাআড়ঙ্গের মতো এত বিশাল পরিসরে খুব কমই নকশিকাঁথাকে তুলে ধরা হয়েছে। সামিউল আলমের নকশা করা এই শিল্পকর্মটি কেবল একটি কাপড়ের টুকরো নয়। এটি ঐতিহ্য, স্থায়ীত্ব এবং সম্মিলিত কারুশিল্পের একটি জীবন্ত উপাখ্যান।
আড়ংয়ের যাত্রার প্রতিফলন
মহাআড়ঙ্গতে আড়ংয়ের বিস্তৃত উত্তরাধিকারকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যার স্থানীয় সাপ্লাই চেইনের অধীনে কাজ করেন ৭৫ হাজার দেশি কারিগর। এর মধ্যে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের অধীনেই আছেন ৩০ হাজার কারিগর। তাদের নিয়ে আড়ং তৈরি করেছে দেশি কারুশিল্পের এক অসাধারণ বাস্তুতন্ত্র। সহযোগী ডিজাইনার নানজিবাকে সঙ্গে নিয়ে সামিউল আলম এই ফ্রেমে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন আড়ংয়ের এই দীর্ঘ যাত্রাকে। যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ যাত্রার কথাও।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সামিউল আলম বলেন, 'বিপুল শক্তি নিয়ে আড়ংয়ের এই ব্যাপক যাত্রা এবং এর কারুশিল্পীদের জাদুকরী নৈপুণ্যের প্রতিফলন আমরা এখানে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। এই নকশিকাঁথায় ফুটিয়ে তোলা গল্প এবং শিল্প দুটোই আমাদের শেকড়ের দিকে নিয়ে যায়। এই কাঁথার মাধ্যমে কারুশিল্পীদের মধ্যের সংযোগ, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের বন্ধন, আমাদের পূর্বপুরুষের অস্তিত্ব, লোককাহিনী, পৌরাণিক কাহিনী, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সবকিছু নতুন রূপে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, যেখানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যতও।'
সাধারণত একটি নকশিকাঁথায় শিল্পীর ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পায়। কিন্তু এই নকশিকাঁথার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। এই কাঁথাটি ২৫০ জন কারুশিল্পীর সম্মিলিত কষ্টের ফসল, যারা তারা ছয় মাস ধরে করেছেন। আবার এটির নকশা প্রথমে কাগজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, যা দেখে সেই নকশা কাপড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পীরা।

সামিউল আলম বললেন, 'সৃষ্টির পথে সম্মিলিত শক্তির যে ক্ষমতা তাকে মূর্ত করে তোলে মহাআড়ঙ্গ। এই শিল্পকর্মটিকে নিখুঁত করতে প্রত্যেক কারিগর তাদের সেরা দক্ষতা প্রয়োগ করেছেন, নিজেদের সেরা অভিজ্ঞতা যুক্ত করেছেন।'
কারিগর বা শিল্পীদের স্বকীয়তা যেন বজায় থাকে তা নিশ্চিত করতে এই নকশিকাঁথা তৈরিতে ঐতিহ্যবাহী কৌশলের পাশাপাশি সমসাময়িক কৌশলগুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ব্লক প্রিন্ট, টাই-ডাই, স্ক্রিন প্রিন্ট, মোম বাটিক এবং শিবুরি বাটিক। এসব কৌশল প্রয়োগের কারণে কাপড়টিতে বৈচিত্র্য এসেছে।
কাপড়ে বুনে চলা স্থায়ীত্ব
এই নকশিকাঁথাটি কেবল কারুশিল্পের প্রদর্শনী নয়, এটি কাপড়ের স্থায়িত্বেরও প্রতীক। পুর্নব্যবহার্য উপকরণ দিয়ে তৈরি এই শিল্পকর্মে ব্যবহৃত হয়েছে দরজিবাড়ি থেকে পাওয়া টুকরো কাপড়, থানের শেষ অংশ, পোশাকে ব্যবহার অযোগ্য নমুনার টুকরো, পুঁতি, বিভিন্ন ধরনের গয়না ইত্যাদি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী হিসেবে এতে ব্যবহৃত হয়েছে পরিহিত শাড়ি, যেগুলোকে কাঁথায় ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে।
সামিউল বলেন, 'নকশিকাঁথার উৎপত্তি হয়েছেই একটি টেকসই ব্যবহার্য সামগ্রী তৈরির ধারণা থেকে। কাঁথা তৈরি করা হয় পুরোনো শাড়ি থেকে, কয়েকটি পুরোনো শাড়ির গল্প জুড়ে তৈরি হয় একটি চমৎকার নকশিকাঁথা। এই কাঁথা জড়িয়ে ঘুমিয়ে আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, সেই স্বপ্ন আমাদের জীবনে নতুন গল্প যোগ করে, শক্তি জোগায়।'

পুনর্ব্যবহার্য কাপড় এবং ঐতিহ্যবাহী কাঁথা ফোঁড় মিলে তৈরি হওয়া চমৎকার নকশার এসব কাঁথাকে বলা যায় সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার অনন্য উদাহরণ। বর্তমানে আমরা যখন পরিবেশ সচেতনতার কথা বলছি, সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার কথা বলছি তখন মহাআড়ঙ্গ নামের এই শিল্পকর্মটি এ দুইয়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সেতুবন্ধন তৈরি করে দেয়।
কারুশিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
মহাআড়ঙ্গের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এতে ফুটিয়ে তোলা আকাশে সোনালি সূর্যোদয়, যেখানে আসলে সেলাই করা হয়েছে এর কারুশিল্পীদের নাম। এই নকশাটির অনুপ্রেরণা সামিউল প্যারিসের 'ওয়াল অব পিস' থেকে নিয়েছেন, যেখানে একসঙ্গে ৩২ টি ভাষায় 'শান্তি' শব্দটি লেখা আছে।
তিনি বলেন, 'আড়ংয়ের আর্কাইভে ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথার কোণে সেলাই করা নাম দেখেই আমাদের এই ভাবনাটি আসে। অনেক সময় দেখা যায়, যিনি কাঁথা সেলাই করেন তিনি কোনো একটি কোণায় নিজের নামটিও লিখে রাখেন। যেহেতু মহাআড়ঙ্গ একটি বিরাট কাঁথা, তাই আমরা আমাদের সবার নাম সূর্যোদয়ের আকাশে লিখে রাখার সিদ্ধান্ত নিই। যাতে করে এর মাধ্যমে ফুটে ওঠে আশা, সমৃদ্ধির চিত্র, প্রকাশ পায় কৃতজ্ঞতাও।'
আরেকটি সূক্ষ্ম কারুকাজের বিষয় হলো, কারুশিল্পীদের আড়ংয়ের আইকনিক ব্যাগ হস্তান্তরের দৃশ্য সূচিকর্মে ফুটিয়ে তোলা। এর মাধ্যমে আমরা কারুশিল্পের পেছনের মুখগুলোকে সম্মান দেখানোর চেষ্টা করেছি, তাদের গল্পগুলোকে শিল্পকর্মের মধ্যেই শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি।'
বিশ্বায়নের যুগে ঐতিহ্য সংরক্ষণ
আমরা এমন একটি সময়ে বাস করছি যখন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে প্রস্তুত পোশাকসহ অন্যান্য সামগ্রী হস্তশিল্পের মতো ঐতিহ্যকে রীতিমতো হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে মহাআড়ঙ্গ কারুশিল্পে মানুষের স্পর্শের অনুভূতির জন্য শক্তিশালী স্মারক হিসেবে কাজ করছে।
প্রশ্ন জাগতে পারে, বিশ্ব যখন ফাস্ট ফ্যাশন এবং যান্ত্রিক উৎপাদনের পথে হাঁটছে তখন সমসাময়িক নকশার ক্ষেত্রে নকশিকাঁথার ভূমিকা কী?
এর উত্তর দিলেন সামিউল।
তিনি বলেন, 'এখন আর নকশিকাঁথার ফোঁড় কেবল গায়ে দেওয়ার কাঁথার জন্যই সীমাবদ্ধ নেই। এটিকে আরও সম্প্রসারণের সময় এসেছে।'
সংরক্ষণ এবং নতুন উদ্ভাবনের সহাবস্থানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ফ্যাশন এবং দৈনন্দিন জীবনে এটিকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ভোক্তা হিসেবে আমাদের অবশ্যই স্থানীয় কারুশিল্প এবং কৌশলগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর তাহলে আমরা এই নকশিকাঁথা জাদুকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব এবং এর উন্নয়ন ক্রমেই উজ্জ্বল হবে।'
সত্যি বলতে কী, ৪৪ ফুট দীর্ঘ এই মাস্টারপিসের সামনে দাঁড়ালে যে কেউ অতীতের সঙ্গে গভীর সংযোগ অনুভব করবেন। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রতি সেলাইয়ের ফোঁড়ে, প্রতিটি পুর্নব্যবহার্য কাপড়ের টুকরোয় এবং প্রতিটি কারিগরে নামের সঙ্গে একটি গল্প জুড়ে আছে। এমন গল্প যা কখনও ম্লান হয় না। নকশিকাঁথার প্রতিটি ফোঁড়ের মধ্য দিয়ে যে গল্প বারবার আমাদের ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেয়।
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments