বিপরীত স্বভাবের কারো সঙ্গে কি সম্পর্কে জড়ানো উচিত

বেশ পুরোনো একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে, বিপরীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুজনের প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি।
বিপরীত স্বভাবের কারো সঙ্গে কি সম্পর্কে জড়ানো উচিত
ছবি: সংগৃহীত

আপনি কি কখনো সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্যের কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন? নিজে কিছুটা লাজুক স্বভাবের ও সৃজনশীল মানুষ হলেও আপনি কি এমন মানুষকে পছন্দ করেন যারা কিছুটা ছটফটে ও বহির্মুখী স্বভাবের? আবার ধরুন, আপনি হয়তো প্রতি সপ্তাহান্তে পার্টি করতে পছন্দ করেন। কিন্তু যাকে পছন্দ করেন তিনি হয়তো সন্ধ্যাবেলা নিরিবিলিতে একান্তে ঘরে থাকাকেই প্রাধান্য দেন। বেশ পুরোনো একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে, বিপরীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুজনের প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি।

নিশ্চয়ই কখনো না কখনো দেখেছেন, ক্লাসের খুব ভালো মেয়েটি কীভাবে যেন হঠাৎ ক্লাসের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ ছেলেটির প্রেমে পড়ে যায়। অথবা আপনার পছন্দের রোমান্টিক কমেডি সিনেমা বা সিরিজে এমন কোনো জুটিও তৈরি হতে দেখেছেন, যা আপনি আশাই করেননি। এক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, দুজন ভিন্নধর্মী মানুষ কি একে অন্যের পরিপূরক হতে পারে?

মনোবিজ্ঞান গবেষক এবং রিলেশনশিপ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর উত্তর হ্যাঁ বা না দুটোই হতে পারে।

এ সম্পর্কে ফাইজা তাসনিম জামান নামের একজনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, 'বৈপরীত্য অবশ্যই একে অপরকে আকর্ষণ করে। দেখুন, একটা সম্পর্কে দুজন মানুষের চিন্তাভাবনায় বৈচিত্র্যই কিন্তু সম্পর্কটির প্রাণ। দুজনের বিপরীত হওয়া আপনার ভালোবাসার সম্পর্কে একটি অন্যরকম মাত্রা নিয়ে আসবে যা আপনি কখনো চিন্তাই করেননি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে, এই ব্যাপারটির ফলে আমি অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি যা বেশ উপভোগ করেছি। আমরা সবসময়ই একে অন্যের জীবনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করতাম, আমার মতে এটি আমাদের সম্পর্কের একটি বিশেষ দিক।'

১৯৬৫টি সফল জুটির উপর ডেভেলপমেন্ট সাইকোলজির করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিপরীত বৈশিষ্ট্যের মানুষ আসলেই একে অপরকে আকর্ষণ করে। এর কারণ হলো, সহজাতভাবেই মানুষের মধ্যে সব ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকা সম্ভব না এবং  আমাদের মধ্যে যা নেই তা আমরা অন্যের মধ্যে খুঁজে পেতে ভালোবাসি। আমাদের অপূর্ণতাগুলোকে লুকিয়ে রাখতে আমরা এমন কাউকে খুঁজি, যারা আমাদের জীবনের সেই অপূর্ণতাগুলোকে দূর করে ভারসাম্য আনবে। বিপরীত মানুষদের এক হওয়ার সবচেয়ে সুন্দর বিষয় হচ্ছে নিজেদের পার্থক্য দিয়ে একে অন্যকে সমর্থন করা, সাহস জোগানো এবং মাঝে মাঝে অন্য রকম কিছু দিয়ে অপরজনকে চমকে দেওয়া। এই সবকিছু মিলিয়ে একটি ভালোবাসাময় দারুণ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়।

২৩ বছর বয়সী মাহদীর ইসলাম বলেন, 'আমার এবং আমার প্রেমিকার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। আমার প্রেমিকা খুব সহজেই মনের ভাব প্রকাশ করে। অন্যদিকে আমি সহজে নিজেকে প্রকাশ করতে পারি না। এই বিষয়টি আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। কারণ সে যদি আমার মত হতো তাহলে আমাদের সম্পর্কটা একঘেয়ে হয়ে উঠত। সে এই সম্পর্কটাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে! এ ছাড়া সে বাংলা গান শুনতে পছন্দ করে, আমি ইংরেজি গান শুনতে পছন্দ করি। ফলে একসঙ্গে দুধরনের গানই শোনা হয় আমাদের।'

কিন্তু সবসময় এবং সবক্ষেত্রে বিপরীত দুজনের সম্পর্ক সুন্দরভাবে এগিয়ে যাবে, এমনটা নাও ঘটতে পারে।

এ সম্পর্কে স্নাতক শিক্ষার্থী প্রত্যাশা চৌধুরী বলেন, 'দুজন মানুষ একই রকম না হলে ভবিষ্যতের জন্য এটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ সেখানে একটি অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মনস্তাত্ত্বিক, মানসিক এমনকি আধ্যাত্মিক দিক থেকে চিন্তা করলেও সামঞ্জস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি এমনটা না হয় তাহলে যেকোনো সম্পর্কে একজন সবসময় সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে নিজের আত্মসম্মান হারিয়ে ফেলেন।'

তিনি আরও বলেন, 'আমার এবং আমার সঙ্গীর মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও আমরা পুরোপুরি আলাদা নই। ভালোবাসা ছাড়াও যেই বিষয়গুলো আমাদের এক করেছে তা হলো ব্যক্তিত্বের মিল, অভ্যাস, আমাদের আশপাশের পরিবেশকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। এ ছাড়াও ধর্ম, পরিবার, নৈতিকতা, সামাজিক বিষয় এবং জীবনের লক্ষ্য এগুলো সম্পর্কে একই ধরনের চিন্তাভাবনা।'

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, বিপরীত বৈশিষ্ট্যের কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর সময় এক ধরনের উৎসাহ কাজ করে। তবে সময়ের সঙ্গে সেই বৈপরীত্যগুলো হৃদয়ভঙ্গের কারণ হয়ে উঠতে পারে। ২০১৩ সালে ই-হারমনি নামের ডেটিং সাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিপরীতধর্মী মানুষের চেয়ে একই রকম মানুষের বেশিদিন একসঙ্গে সুখে থাকার প্রবণতা বেশি।

এ ব্যাপারে মৃদুভাষী তানজিদুর রহমান নক্ষত্র বলেন, 'আমি কিছুটা লাজুক ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। ফলে আমি চেয়েছিলাম এমন কাউকে যে অন্যদের সঙ্গে ভালো মিশতে পারবে। কিন্তু আমি যেভাবে ভেবেছিলাম তা হয়নি। তার লক্ষ্য, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা কিছুই আমার সঙ্গে মিলেনি। আমার মতে, দীর্ঘদিনের সম্পর্কে দুজন মানুষের ব্যক্তিত্ব, একই রকম মানসিকতা এবং সামঞ্জস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'

মানুষ হিসেবে আমরা সাধারণত বয়স, ধর্মীয় দৃর্ষ্টিকোণ, লেখাপড়া এবং শখের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য খুঁজি। আপনি যদি কোন কিছু নিয়ে খুব আগ্রহী হোন, নিশ্চয়ই চাইবেন আপনার কাছের মানুষটিও সেটি নিয়ে একই রকম আগ্রহ প্রকাশ করুক। কিন্তু যদি তিনি আপনার থেকে এতটাই অন্যরকম হন যে, আপনার আগ্রহ নিয়ে তার কোনো  মাথাব্যথা নেই, তাহলে তা আপনাকে বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। আবার একই রকম আগ্রহের অন্য কারো সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্য খুঁজে পেলে সেখান থেকে আপনার সঙ্গীর এক ধরনের  ঈর্ষা তৈরি হতে পারে। এসব কারণে সঙ্গীর সঙ্গে ঝগড়া, মনোমালিন্য সৃষ্টি হতে পারে।

তবে কী আপনার বিপরীত বৈশিষ্ট্যের কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানো উচিত হবে?

এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দিয়ে দেওয়া কঠিন। আপনি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হতে পারে, এটি জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে ভারসাম্যও আনতে পারে। তবে যদি অর্থ, সন্তান, ধর্ম, পারিবারিক বাধ্যবাধকতা, সম্পর্কের নিয়মকানুন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খাপ খাওয়াতে না পারেন, তাহলে এই ধরনের সম্পর্কে না আগানোই ভালো। খেয়াল রাখতে হবে, অপর মানুষটি আপনাকে কী রকম রেখেছেন। আপনার আবেগকে বোঝার চেষ্টা করুন এবং যদি বিপরীত চরিত্রের মানুষটির সঙ্গে আপনি সুখে থাকেন তাহলে তার সঙ্গেই থাকুন।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments