আধুনিক প্যারেন্টিং ও শ্রদ্ধাবোধের বদলে যাওয়া সংজ্ঞা

আধুনিক প্যারেন্টিং, শ্রদ্ধাবোধের সংজ্ঞা,
ডিজাইন: সায়েদা আফরিন তকারান্নুম

বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ বাবা-মা বা দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানি মনে করেন যে, শিশুরা তাদের যথাযথ শ্রদ্ধা করে না। তারা মনে করেন, আগের তুলনায় এখনকার শিশুরা বড়দের প্রতি কম শ্রদ্ধা দেখায়। আর এজন্য দায়ী করা হয় পারিবারিক কাঠামো ও লালন-পালনের পরিবর্তিত পদ্ধতিকে।

গত কয়েক দশকে শিশুদের শেখানো হতো কাকে অবশ্যই সম্মান বা শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। যার মধ্যে ছিলেন বাবা-মা, শিক্ষক; এমনকি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও। তাদের শেখানো হতো, বড়দের সঙ্গে কথা বলার সময় প্লিজ বা অনুগ্রহ করে শব্দের প্রয়োগ করতে। কাজ শেষে ধন্যবাদ দিতে এবং তাদের যথাযথ সম্বোধন করতে। আবার বড়দের বা গুরুজনদের পাল্টা প্রশ্ন করা যাবে না, এমন রেওয়াজও ছিল।

সাধারণত পরিবারের সবাই মিলে রাতের খাবার খাওয়ার সময় পরীক্ষা করা হতো যে ছোটরা ঠিকঠাক শিষ্টাচার শিখেছে কি না, তারা সবার সঙ্গে সঠিক ব্যবহার করছে কি না।

আধুনিক সময়ে সবচেয়ে পার্থক্য এসেছে পারিবারিক কাঠামোতে। তখন অর্থনৈতিক চাপ তুলনামূলক কম থাকায় বাবা-মা দুজনের মধ্যে অন্তত একজন সন্তানদের সঙ্গে সারাদিন থাকতেন। তিনি সন্তানদের যথাযথ আচরণ শেখাতেন, পরিবারের সদস্যদের কীভাবে সম্মান করতে হবে তার পাঠ দিতেন।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে পারিবারিক কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে। এখন মানুষ অনেক ব্যস্ত, অর্থনৈতিক চাপ বেড়েছে। ফলে পরিবারগুলোকে দ্বৈত আয়ের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে, যে কারণে বাবা-মা দুজনকেই কর্মক্ষেত্রমুখী হতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আগের মতো সন্তানদের পেছনে সার্বক্ষণিক সময় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

আগের দিনে প্যারেন্টিংকে খুব জটিল হিসেবে দেখা হতো না। বরং মনে করা হতো, অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো ভদ্র, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হিসেবে সন্তানদের গড়ে তোলা। সে কারণে শৃঙ্খলা কঠোরভাবে মেনে চলতে শেখানো হতো। তবে সেসময় একজন শিশুর স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খুব কমই মনোযোগ দিতেন পরিবারের বড় সদস্যরা।

সে তুলনায় এখনকার অভিভাবকরা তাদের সন্তানের আবেগের বিষয়ে অনেক সচেতন। সন্তান কোনো আচরণ করলে তারা আগে সেটির উৎস খুঁজতে যান। কী কারণে সে এমন আচরণ করছে তা খোঁজার চেষ্টা করেন, তারা সেটি লুকিয়ে রাখতে চান না।

এখন অভিভাবকরা সন্তানদের সঙ্গে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করেন, যা দীর্ঘমেয়াদে সন্তানদের ব্যক্তিত্ব গঠনে কাজে লাগে বলে মনে করা হয়। এর মাধ্যমে সন্তান তার ভুলগুলো বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী নিজেকে সংশোধন করে নেয়। অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়ার চেয়ে এই পদ্ধতি সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য ভালো।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তন এসেছে সেটি হলো, রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে শিশুদের মেলামেশার ক্ষেত্রে।

অতীতে পরিবারের সদস্য কিংবা কিছু প্রতিবেশীই হয়তো ছিলেন শিশুদের কাছে রোল মডেল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টেলিভিশন বা বইয়ের লেখকরাও এই জায়গা দখল করতেন। কিন্তু এখন শিশুদের হাতে আছে ইন্টারনেট। আর সেই জগতে আছে অসংখ্য ইনফ্লুয়েন্সার বা রোল মডেল, যা শিশুদের মূল্যবোধ তৈরির ক্ষেত্রে এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সেইসঙ্গে তাদের প্রথাগত শিক্ষাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। কারণ এতসব দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা বেশ কঠিন কাজ।

বিষয়টি এভাবেও দেখা যেতে পারে যে, এখনকার দিনের শিশুরা অতীতের শিশুদের তুলনায় নিজের সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সবাইকে অন্ধভাবে সম্মান করতে শেখানোর ফলে মানুষের মধ্যে এমন প্রবণতা গড়ে ওঠে, যাকে বলা হচ্ছে পিপল প্লিজিং বিহেভিয়ার। অর্থাৎ, তার ব্যক্তিত্ব এমন গড়ে ওঠে যে কেবল অন্যকে আনন্দই দিতে চায়। কারণ তারা সবসময় সবার কাছে ভালো হতে চায়, অন্যের মনোরঞ্জনের জন্য নিজের কণ্ঠস্বরকেও দমন করে।

এসব বিষয়ে বর্তমান সময়ের অভিভাবকরা অনেক বেশি সচেতন। কারণ তাদের হাতে রয়েছে শিশুপালন সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের গবেষণা। তারা জানেন, অন্যকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে নিজেকে বঞ্চিত করা সঠিক নয়। এক্ষেত্রে কখনো কখনো হয়তো প্রথাগত সম্মানের অভাব রয়েছে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে তা সঠিক নয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমান প্রজন্ম সম্মান দিতে জানে না বলে যে একটি ধারণা গড়ে উঠেছে, তা আসলে প্রজন্মগত ভুল বোঝাবুঝি। সবকিছু বিবেচনা করলে এটা বলাই যায় যে, বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের দেখার দৃষ্টি আলাদা। তারা তাদের নিজস্ব দক্ষতা আর সামাজিক প্রত্যাশা নিয়ে পথ চলে। জীবনকে দেখার জন্য তাদের রয়েছে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি।

এই বিষয়টিকে যদি ইতিবাচকভাবে দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে যে বড়দের প্রতি সম্মান কমেনি। এটা অন্যভাবে বিকাশ লাভ করেছে। যেহেতু প্রজন্মের সঙ্গে পরিস্থিতির খাপ খাওয়ানোর পদ্ধতিও বদলায়, তাই সম্মানের ধারণাও সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে। তাই সম্মানের ধারণাটি এখন কেবল কর্তৃত্ববাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এটি আগের চেয়েও অনেক সরল হয়েছে।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

Comments