বাংলাদেশে সিঙ্গেল ফাদারদের অদেখা চ্যালেঞ্জ

সিঙ্গেল বাবা
ছবি: সংগৃহীত

আমার পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছিলাম। নির্ধারিত সময়েই ফ্লাইট ছেড়েছিল। কিন্তু ১৫ মিনিট পরই আমরা শুনতে পেলাম ক্যাপ্টেনের ঘোষণা। তিনি জানালেন, আবহাওয়া খারাপ থাকায় ঢাকায় অবতরণ নিরাপদ নয়। তাই তিনি আমাদের নিয়ে আবার চট্টগ্রাম ফেরত যাচ্ছেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও শত শত যাত্রীর সঙ্গে আমরা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আটকা পড়লাম। আটকে পড়া অনেক পরিবারের সঙ্গেই শিশুরা ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিরক্ত হতে শুরু করল। সে তুলনায় আমার ছেলে বেশ শান্তভাবেই আমার পাশে বসে ছিল। কখনও মোবাইল ফোনে খেলছিল, কখনও আমার সঙ্গে টুকটাক কথা বলছিল।

আমাদের পেছনে বসে দুজন বয়স্ক নারী তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের সম্পর্কে কথা বলছিলেন। কিছুক্ষণ পরেই আমি আর আমার ছেলে তাদের কথার বিষয়বস্তু বুঝতে পারলাম, তারা আমাদের নিয়েও কথা বলছিলেন! একজন আরেকজনকে বলছিলেন, `বাহ! কত লক্ষ্মী একটা ছেলে। মা ছাড়াও শান্ত হয়ে বসে আছে।` তাদের কথায় খুব সূক্ষ্মভাবে `মা ছাড়া` শব্দটির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল।

এসব শুনে আমার আর ছেলের মধ্যে এক ধরনের শীতল নীরবতা বিরাজ করছিল। আমি ভাবছিলাম যে, আমার ছেলের মনে আসলে সে সময় কী চলছে? কিন্তু তাকে এটা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস আমার হচ্ছিল না। তার বদলে আমি আশপাশের অন্য পরিবারগুলোর দিকে তাকালাম। বেশিরভাগ পরিবারই ছিল ছোট শিশুদের সঙ্গে দম্পতি, যেখানে মায়েরা শিশুদের খাওয়াচ্ছিলেন এবং বাবারা খেলছিলেন। হঠাৎ করে আমার মনে হলো, আমরা এসব দলের ভেতর নেই। সবার মধ্যে আমরা আলাদা, শুধু বাবা আর ছেলে। ভ্রমণকারী অন্য পরিবারগুলোর মতো আমরা দেখতে নই। আমরা অন্যদের চোখে আদর্শ পরিবার নই। কারণ আমি একজন সিঙ্গেল বাবা, যে একা হাতে সন্তানকে লালনপালন করি।

আমার ছেলে পরিবারে মা ও বাবার ভূমিকার পার্থক্য বোঝে না। সে একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, স্কুলে মা দিবস পালনের অনুষ্ঠানে কেন আমাকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। আমার এবং আমার ছেলে চোখে যা স্বাভাবিক, অন্য অনেকের চোখে তা অস্বাভাবিক। এমনকি এক বন্ধুর তিন বছরের মেয়েশিশুর চোখেও এটা ধরা পড়েছিল এবং সে আমার ছেলের কাছে জানতে চেয়েছিল যে সে কেন কখনও তার মায়ের সঙ্গে আসে না। সেবার প্রথমবারের মতো আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, কেবল আমিই নই, আমার ছেলেও সমাজের স্বাভাবিক রীতিনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। আমি নিজেকে সমাজের বাইরের মানুষ হিসেবে মেনে নিয়েছি। কিন্তু পরে বুঝেছি, এটি সহজ নয়। এ বিড়ম্বনা দীর্ঘমেয়াদী।

প্রথমবার ছেলেকে নিয়ে যখন একা ভ্রমণ করি তখন ওর বয়স সাড়ে তিন। অফিসের বার্ষিক ছুটিতে নেপাল যাচ্ছিলাম এবং ভেবেছিলাম দুজনে মিলে অনেক মজা করব।

যাত্রার শুরুতেই ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা বেশ জোরের সঙ্গেই প্রশ্ন করলেন, 'ওর মা কোথায়?' আমি শান্তভাবে উত্তর দিলাম, 'তিনি আমাদের সঙ্গে ভ্রমণে যাচ্ছেন না।'

অফিসার পারপোর্টের পাতা উল্টাতে উল্টাতে প্রশ্ন করলেন, 'কেন? আপনি কি সন্তান নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার অনুমতি নিয়েছেন?'

তার এই প্রশ্নে আমার রাগ হয়েছিল। তবু আমি বেশ শান্ত থেকে উত্তর দিলাম, 'পাসপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে সে আমার ছেলে। তাহলে কেন তার মায়ের অনুমতি লাগবে?'

অফিসার বললেন, 'মায়ের অনুমতি ছাড়া শিশুটিকে আপনার সঙ্গে যেতে দিতে পারব না।'

এই ঘোষণার পর তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ডাকলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে সুপারভাইজারের কক্ষে ডাকা হলো। তারা জানিয়ে দিলেন, হয় শিশুর মাকে আসতে হবে, নয়তো আমাদের বাড়ি ফিরে যেতে হবে।

আমি দ্রুত ছেলের মাকে ফোন করলাম, তিনি কিছুক্ষণ আগেই আমাদের এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেছেন। আবার ফিরে আসতে তার ২০ মিনিট সময় লেগেছিল। এর মধ্যে এসব কিছু দেখে আমার ছেলে কাঁদতে শুরু করে দিল। তার কান্না দেখে শিফট সুপারভাইজার যেন খুশি হয়ে উঠলেন।

তিনি বললেন, `আমি আগেই বলেছিলাম শিশুটি কাঁদবে।'

চারপাশে কেবল কয়েকজন পুলিশ অফিসারকে দেখলাম, যারা আমাদের দিকে তাকিয়ে আমার বিচার করছিলেন। তবে অগ্নিপরীক্ষার এখানেই শেষ নয়।

ইমিগ্রেশন অফিসার আমার তখনকার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন যে কেন তিনি আমাদের সন্তানকে আমার সঙ্গে একা ভ্রমণের অনুমতি দিচ্ছেন? যদি ভ্রমণে গিয়ে আমি সন্তানের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি, তাকে মারধর করি? আমি কীভাবে তাকে খাওয়াবে বা ঘুম পাড়াব? তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল আমি বাবা হলেও সন্তানের পূর্ণাঙ্গ অভিভাবক নই। সেই সময় আমি এটাই ভাবছিলাম যে, মা এবং বাবার মধ্যে অভিভাবকত্বে কেন এত পার্থক্য থাকবে?

সেই নেপাল ভ্রমণটা আসলে আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। কাঠমান্ডুর প্রথম রাতটি ছিল খুবই কঠিন। ছেলের ঠান্ডা লেগেছিল এবং তার কানে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছিল। আমি আবিষ্কার করলাম যে, আমি আসলে তার পছন্দের খাবার তৈরি করতে পারি না। আর এজন্য স্কাইপ কলে তার মায়ের সাহায্য নিতে হয়েছিল। আমি সারারাত ছেলের কানে হাত দিয়ে রেখেছিলাম, যেন সে কিছুটা আরাম বোধ করে।

পরের কয়টি দিন সত্যিই আমার জন্য শিক্ষণীয় ছিল। আমরা দুজনেই যে যার জায়গা থেকে নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে, ছেলের সঙ্গে এতটা সময় একা আগে কখনও কাটাইনি। সেসময় আমরা খুঁজে বের করেছিলাম যে, কীভাবে নিজেদের মধ্যে সহজে যোগাযোগ করব। আমি তার কাছ থেকে এমন ছোট ছোট অনেক জিনিস শিখেছি যা আমি আগে জানতাম না। সে কেমন পোশাক পরতে পছন্দ করে বা তাকে খাওয়ার সেরা পদ্ধতি কী, তখনই জেনেছি। বাবা হিসেবে এটা ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ঘটনাক্রমে সেবার কাঠমান্ডু থেকে ঢাকার ফ্লাইট মিস করি। কিন্ত এরপরই আমার নয়াদিল্লিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। কিন্তু আরও দুদিন কাঠমান্ডুতে ফ্লাইটের জন্য বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

তাই ছেলের মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা পরবর্তী ফ্লাইটে ভারত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, যেহেতু আমাদের দুজনেরই ভারতীয় ভিসা ছিল। কথা ছিল ছেলের মা দুদিনের মধ্যে দিল্লিতে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন। তাই আমরা ঢাকার বদলে দিল্লির ফ্লাইটে উঠলাম। বিমানবন্দরে আমাদের দুজনকে কল্পনা করুন। সঙ্গে কয়েকটি স্যুটকেস, একটি স্ট্রলার, ছোট্ট গিটার আর ছেলে ক্যারি অন ব্যাগ। আমার ছেলে সম্ভবত তার বাবার চেহারার অসহায়ত্বকে পড়তে পেরেছিল। আর তাই তো নেপাল থেকে কেনা ছোট্ট গিটার এবং নিজের ক্যারি অন ব্যাগটি নিজেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল আমার সাড়ে তিন বছরের ছোট্ট ছেলেটি। ইমিগ্রেশন শেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবেই সে আমাকে সাহায্য করেছে।

এরপর দেশ এবং দেশের বাইরে আমরা দুজনে অনেকবার ভ্রমণ করেছি। সব জায়গাতেই আমাদের মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টির মুখে পড়তে হয়েছে। সব জায়গাতেই এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে, 'ওর মা আসেনি?'

তবে মুদ্রার অন্য পিঠও আছে। অনেক সময়ই আমরা অযাচিত ভালোবাসা আর যত্ন পেয়েছি। যেমন একবার সিলেটের একটি বিলাসবহুল রিসোর্টের প্রধান শেফ আমার ছেলেকে আমার রান্নাঘর ঘুরে দেখার এবং তার পছন্দমতো দুপুর ও রাতের খাবার বেছে নেওয়ার ও তাকে বেকিং শেখানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পরদিন সকালে রেস্তোরাঁর কর্মীরা তাদের মেন্যুর বাইরে গিয়ে আমাদের খাবার পরিবেশন করেছিলেন। আমরা যত বেশি ভ্রমণ করতে শুরু করলাম তত বেশি নিজেদের বুঝতে পারলাম এবং একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস বাড়তে লাগল।

বাবা হিসেবে বিবর্তনের ধাপে আমি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমার সেই সব বন্ধুদের কাছ থেকে দেখতে শুরু করলাম যারা আমার মতো নতুন পারিবারিক কাঠামো বেছে নিয়েছিল। একজন তার ছয় বছরের মেয়েকে আমার মতোই একা ভ্রমণে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমন একজনকে জানি, যিনি স্ত্রী ইউরোপে পিএইচডি করতে যাওয়ায়, ওই সময়টুকু মেয়েকে একা বড় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি অনেক উদ্যোক্তাকে চিনি যারা তাদের সন্তানদের সঙ্গে সারাদিন বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অথচ উদ্যোক্তা জীবনের পাশাপাশি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাওয়া সহজ নয়।

আমার জন্য সিঙ্গেল বাবার জীবন শুরু করা সহজ ছিল না। আমাকে ছেলের স্কুলের শিক্ষকদের বিশ্বাস অর্জন করতে হয়েছিল, যেন তারা ছেলের অগ্রগতির বিষয়ে আমার সঙ্গে সহজেই আলাপ করতে পারেন। স্কুলের অন্য অভিভাবক মায়েদের ভিড়ে আমি ছিলাম একমাত্র বাবা। আমার বন্ধু ফেসবুকে মায়েদের একটি গ্রুপ খুলেছিল এবং সেখানে সে আমাকে যুক্ত করেছিল। কারণ তার ধারণা ছিল, আমিও মায়ের মতো সমান কাজ করি। এখন আমি বুঝতে পারি যে, বাবা কিংবা মা নয়। আমি সবার আগে একজন অভিভাবক। আমার কাছে সন্তানের চাহিদাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে অদ্ভুত বিষয় হলো, সিঙ্গেল বাবা না হলে বা সন্তানকে একা হাতে বড় করতে না হলে আমার মধ্যে এই বোধ হয়ত কখনোই আসত না।

তাই আপনি বাবা বা মা যেই হোন না কেন, সন্তানের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক যাচাই করতে তার সঙ্গে একা ভ্রমণ করা উচিত। এটি আমার জীবন বদলে দিয়েছে এবং আমি হলফ করে বলতে পারি আপনি যদি সাহস করে সন্তানকে নিয়ে একটা একবার ভ্রমণ করেন তাহলে তা আপনার জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দেবে।

*লেখক ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখাটি মূলত `মেন ডোন্ট টক` শিরোনামের একটি নাটকের জন্য লেখা হয়েছিল। বহ্নিশিখা প্রযোজিত নাটকটি লিঙ্গ সমতার প্রচারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

 

Comments

The Daily Star  | English
enforced disappearance in Bangladesh

Enforced disappearance: Anti-terror law abused most to frame victims

The fallen Sheikh Hasina government abused the Anti-Terrorism Act, 2009 the most to prosecute victims of enforced disappearance, found the commission investigating enforced disappearances.

8h ago