কীভাবে বুঝবেন আপনি টক্সিক প্যারেন্টিং করছেন

টক্সিক প্যারেন্টিং
ছবি: সংগৃহীত

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে নাঈম। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া নাঈমের বন্ধুরা একটু দূরের মাঠে ফুটবল খেলে প্রতিদিন। নাঈমেরও ডাক পড়ে সেই খেলায়, কিন্তু মায়ের কড়া আদেশ অমান্য করে সে যেতে পারে না। বিকেলে খেলা বাদ দিয়ে শিক্ষকদের বাসায় দৌঁড়ানো মা-বাবা পছন্দ করলেও নাঈমের তা ভালো লাগে না।

আট বছরের রাইসা। বাসাভর্তি মেহমানের সামনে তাদেরই আনা চকলেট নেওয়ার আবদার করলে তার মা সবার সামনেই বকা দেন। তার মা মনে করেন, বাচ্চাদের 'ম্যানার' শেখানো খুবই প্রয়োজন। কিন্তু ছোট্ট রাইসার মনে জমে অপমানবোধ।

উপরের দুটি ঘটনা পড়ে মনে হতে পারে, বাবা-মা ভালোর জন্যই সবসময় এমনটা বলে বা করে বলে থাকেন। আর সন্তানদেরকে মানুষ করতে একটু আধটু শাসন করতেই হয়। কিন্তু এই শাসন কখন যে 'টক্সিক প্যারেন্টিং'য়ে রূপ নেয়, বাবা-মা অনেক সময় টের পান না। তারা হয়তো বুঝতেও পারেন না,  তাদের আচরণের এই দিকটি সন্তানের মানসিক বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

টক্সিক প্যারেন্টিংয়ের ফলে সন্তানের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে এবং বাবা-মা হিসেবে কী করণীয় তা নিয়ে আলোচনা করেছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মাহবুব আজাদ।

টক্সিক প্যারেন্টিং কী

মাহবুব আজাদ বলেন, কিছু বাবা-মায সন্তানদের মারাত্মক রকমভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। সন্তান কোন বিষয় নিয়ে পড়বে, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, কাকে তার জীবনে আনবে, এমনকি কতটা নিঃশ্বাস নেবে, পারলে সেটা পর্যন্ত ঠিক করে দেন। এই ধরনের ডমেনেটিং প্যারেন্টিংকে বলা হচ্ছে টক্সিক প্যারেন্টিং।

বাচ্চাকে লালনপালন করতে যত্ন যেমন দরকার, তেমনি প্রয়োজনে শাসন করা অবশ্যই দরকার। কিন্তু সেটার একটা সীমা আছে। সীমা পেরোলে অতিরিক্ত শাসন হোক বা অতিরিক্ত কেয়ার, দুটিই রীতিমতো অত্যাচারে পরিণত হয়। অতিরিক্ত কেয়ারিং মনোভাব অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ওপর সন্তানদের এত নির্ভরশীল করে তোলে যে তারা যেন তাদের নিজেদের বিচার-বুদ্ধির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। বাবা-মা মানেই বাচ্চার সঙ্গে যা খুশি করার অধিকার নেই। না বুঝে অনেক বাবা-মা এই ভুল করে থাকেন।

আপনি কি টক্সিক প্যারেন্টিং করছেন?

'ছেলেমেয়ের ভালোর জন্যই তো' এই কথা বলে অনেক বাবা-মা এমন আচরণ করেন ফেলেন, যেটা সন্তানদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। বাবা-মা হয়তো জানেনই না এই আচরণ টক্সিক প্যারেন্টিংয়ের অংশ।

মাহবুব আজাদ বলেন, শারীরিক আঘাত, চাপিয়ে দেওয়া মনোভাব, সন্তানদের মনে ভীতি সৃষ্টি করে কাজ করানো, সন্তানদের প্রতি কাজে দোষ ধরা, অতিরিক্ত নিন্দা বা সমালোচনা করা টক্সিক প্যারেন্টিংয়ের লক্ষণ। আবার অতিরিক্ত আদর ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়াও এক ধরনের টক্সিক প্যারেন্টিং। অনেক বাবা মা বুঝতেই পারেন না যে তারা তাদের সন্তানের সঙ্গে টক্সিক আচরণ করছেন।

তিনি আরও বলেন, আপনি টক্সিক আচরণ করছেন কিনা সেটা বুঝতে হলে আপনি আপনার শৈশবে ফিরে যান এবং চিন্তা করুন আপনার বাবা-মায়ের কোন আচরণগুলো আপনাকে পীড়া দিত কিংবা নেতিবাচক প্রভাব ফেলত। এতে করে বুঝতে অনেকাংশ সুবিধা হবে আপনি কী ধরনের প্যারেন্টিং করছেন।

টক্সিক প্যারেন্টিংয়ের নেতিবাচক দিক

টক্সিক প্যারেন্টিং শিশুদের নরম মনে দাগ ফেলে, অনেক ক্ষেত্রে সেই দাগ বয়ে বেড়াতে হয় জীবনের বড় একটা সময়। আপনি হয়তো বা রাইসার বাবা-মার মতো ভাবতে পারেন যে, বাচ্চাকে ম্যানার শেখাচ্ছি। কিন্তু সবার সামনে অপমানিত হয়ে তার কেমন লাগছে বা সে আদৌ কিছু শিখছে কি না সেটা ভেবে দেখেছেন কখনো?

মাহবুব আজাদ বলেন, টক্সিক প্যারেন্টিংয়ের শিকার হলে শিশু অল্পতে রেগে যায়, জেদি হয়ে উঠতে পারে, আত্মবিশ্বাস কমে যায়, আবার অনেক সময় বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে উঠে।

মা-বাবার টক্সিক প্যারেন্টিংয়ে সন্তান অনেক সময় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠে। ফলে সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারে না। সেই সন্তানরা নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলে। অনেক সময় ভুল মানুষের সঙ্গে মেশে।

মা-বাবা 'টক্সিক' হলে শিশুর চাওয়া-পাওয়াকে তারা কম গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাদের চাওয়া হয়তো ছোট হতে পারে। কিন্তু সেটাকে গুরত্ব না দিলে আপনার সন্তান নিজেকে বঞ্চিত মনে করবে। তখন ছোটখাটো বিষয় নিয়েও সে অতিরিক্ত জেদ করতে পারে। নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে না।

অতিরিক্ত শাসন যেরকম ভালো ফল নিয়ে আসে না, ঠিক তেমনি অতিরিক্ত আদরও সন্তানের জন্য কল্যাণকর নয়। অতিরিক্ত আদর বা সন্তানের অযৌক্তিক সব আবদার মেনে নেওয়াও এক ধরনের টক্সিক প্যারেন্টিং। এতে করে শিশু পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে নিজেকে পরে মানিয়ে নিতে পারে না।

বাবা-মার করণীয়

সময়ের সঙ্গে বদলেছে প্যারেন্টিং। মা-বাবা চিন্তা করতে পারেন, আমাদের সময় তো এত ট্রার্ম শুনিনি কিংবা কই আমাদের বাবা-মা তো বেধড়ক পিটিয়েছেন। আমরা কি মানুষ হইনি? এই ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নিজেদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ থাকলে তা দুজনে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে মিটিয়ে ফেলতে হবে।

পরিবারের যদি সুস্থ পরিবেশ না থাকে তবে সন্তানদের ওপর বিরূপ প্রভাব পরে। অনেক সময় ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আক্রোশের শিকার হয় সন্তানরা। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এটা মাথায় রাখতে হবে, তারা আলাদা একটা সত্ত্বা। তাদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে।

মাহবুব আজাদ বলেন, যদি বুঝতে পারেন আপনি টক্সিক প্যারেন্টিং অনুসরণ করছেন, তবে বাবা-মা হিসেবে সেরাটা দিতে চাইলে নিজেকে শুধরে নিতে হবে। সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। প্রয়োজনে একজন অভিজ্ঞ প্যারেন্টিং কাউন্সিলরের শরণাপন্ন হতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Is the US winning under Donald 'Tariff' Trump?

President Trump has now been president for almost 100 days.

4h ago