হজ: আজীবন মনে রাখার মতো স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা
ইসলাম ধর্মের ৫টি স্তম্ভের একটি হজ। প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও এই ইবাদতটি করতে চান। যারা এই ফরজ ইবাদতের যোগ্যতা অর্জন করেন, তারা শুধু অপেক্ষায় থাকেন এই মহিমান্বিত যাত্রার জন্য উপযুক্ত সুযোগের।
অনেকের মতো, আমিও হজে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। হঠাৎ করেই চলে এলো সেই সুযোগ। যখন এজেন্সি নিশ্চিত করলো যে আমি ও আমার স্বামী এ বছর হজে যেতে পারছি, তখন আবেগাপ্লুত হয়ে যাই। এই সুযোগ দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহ্ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করি।
আমাদের হজ ফ্লাইটের দিন সব প্রস্তুতি নিয়ে, উমরাহর নিয়ত করে, ইহরাম বেঁধে হজযাত্রী হিসেবে যাত্রা শুরু করলাম।
সৌদি আরবের জেদ্দা বিমানবন্দর অবতরণ করে সেখান থেকে আমরা যাই মক্কায়।
হোটেলে রাতের খাবার শেষে ওমরাহর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ৫-৬ মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেলাম মসজিদুল হারামে। প্রথমবারের মতো কাবার দর্শন পাওয়ার পর সুনির্দিষ্ট কিছু দোয়া করার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।
মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে কাবার সামনে দাঁড়ালাম। আল্লাহ্র ঘর কাছ থেকে দেখে আমি ছিলাম নির্বাক। যেসব দোয়া পড়বো বলে ঠিক করেছিলাম, তার সবটাই ভুলে গিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে আমি সেই কাবা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি; যে দিকে মুখ ফিরিয়ে পৃথিবীর কয়েক কোটি মুসলমান প্রতিদিন নামাজ আদায় করেন। এই মুগ্ধতার অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
কিছুক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে কাবার দিকে মুখ করে প্রার্থনা করলাম।
এরপর আমরা তাওয়াফ শুরু করলাম। জীবনসঙ্গীর হাত ধরে তাওয়াফ করছি। একজন মানুষের জীবনে এরচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কী হতে পারে? তাওয়াফ শেষে আমরা সাফা-মারওয়ায় সাঈ করি।
উমরাহ পালন শেষে মানুষ যত বেশি সম্ভব তাওয়াফ, নামাজ ও কুরআন পড়া এবং জিকির করতে চায়। আমিও মূল হজ শুরুর আগের কয়েকটি দিন এসব ইবাদতে যতটা সম্ভব নিজেকে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করেছি।
হজের মূল কার্যক্রমগুলো জ্বিলহজ্জ মাসের অষ্টম দিন থেকে শুরু হয়। এই দিনটিতে আমরা আবারও হজের মূল কার্যক্রমগুলো পালনের জন্য ইহরাম বাধলাম ও মিনায় গেলাম। সেখানে আমরা তাঁবুতে রাত কাটাই। নারী ও শিশুরা ক্যাম্পের একটি অংশে এবং পুরুষরা থাকেন অন্য একটি অংশে।
পরের দিন আমরা আরাফাতের ময়দানে যাই, যেটি হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানেই হাজীরা জমায়েত হয়ে পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালার কাছে দুই হাত তুলে ক্ষমা, দয়া ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য দোয়া চান। এই আরাফাতের ময়দানেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার সঙ্গে উপস্থিত হাজিদের উদ্দেশ্যে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন।
মানুষ এখানে দুই হাত উঁচু করে দোয়া চান আল্লাহর কাছে। এটা এমন এক জায়গা, যেখানে মানুষ আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন।
সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে থাকার পর আমরা মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আরাফাত থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জায়গাটিতে পৌঁছানোর জন্য আমরা একটি বাসে চরলাম। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পথ হারিয়ে ফেলি। বেশ কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় থাকার পর অবশেষে আমরা মুজদালিফায় একটি থাকার জায়গা খুঁজে পাই।
মুজদালিফায় লাখো হজযাত্রীর মতো আমরাও মাটিতে একটি মাদুর বিছিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে রাত কাটালাম।
ঘুমানোর আগে আমরা ছোট নুড়ি ও পাথর সংগ্রহ করেছিলাম, যেগুলো পরবর্তী দিন জামারাতে নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজন ছিল।
পরের দিন আমরা ফজরের পর মুজদালিফা ছেড়ে বাসে করে জামারাতের উদ্দেশ্যে রওনা হই। জামারাতে আমাদের কাজ ছিল ৭টি পাথর ছুঁড়ে মারা, যেটি শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মারার একটি প্রতীকী প্রকাশ। তারপর আমরা মক্কায় ফিরলাম।
সৌদি সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, আমাদের পক্ষ থেকে একটি স্থানীয় ব্যাংক কুরবানি দেওয়ার ওয়াজিব কাজটি সম্পন্ন করে। তাদের কাছ কুরবানি শেষ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা পাওয়ার পর আমার স্বামী তার মাথার চুল কামিয়ে ফেলেন এবং ইহরাম ছেড়ে দেন। হজের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তিনি আমার মাথার চুলও কেটে ছোট করে দেন।
১ ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়ার পর আমরা আবারও মসজিদুল হারামে গিয়ে ফরজ তাওয়াফ ও সাঈ করি।
আমাদের ৫ দিনব্যাপী হজ শেষ হওয়ার আগে আবারও ২ দিনের জন্য মিনায় ফিরে যাই এবং নিয়ম অনুযায়ী জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করি। হজের সব রীতি পালনের জন্য আমাদের প্রচুর হাটতে হয়েছে। সুতরাং এটা বলাই যায় যে হজ পালনের জন্য শারীরিকভাবে সুস্থ ও সবল থাকা খুবই জরুরি।
হজ এমন একটি স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা, যেটি আপনি সারা জীবন মনে রাখবেন। এ ছাড়াও, বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এটি হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর একটি যাত্রা।
বিদায়ী তাওয়াফের মাধ্যমে ১৩ জ্বিলহজ্জ আমরা হজের সব অত্যাবশ্যক কার্যক্রম শেষ করি।
আল্লাহ্ আমাদের হজকে কবুল করুন।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments