ইতিহাস ও নান্দনিকতার রহস্যে ঘেরা ফতেপুর সিক্রি

শক্ত পাথরে হাতের স্পর্শমাত্রই অনুভূত হয় ইতিহাস, বিজয়, গৌরব, শান-শওকত, অত্যাচার, পরাধীনতা, গ্লানি কিংবা নীরবে ঝরে যাওয়া অশ্রুজল। কান পাতলে যেন আজও শোনা যায় সেই সময়ের মুঘল কথোপকথন।
ফতেপুর সিক্রি
ফতেপুর সিক্রি। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আগ্রার ফতেপুর সিক্রি। শুধু লাল বেলেপাথরের সৌন্দর্য নয়, ফতেপুর সিক্রির আকাশে বাতাসে মিশে আছে ইতিহাসের অনেক জানা-অজানা গল্প। 

শক্ত পাথরে হাতের স্পর্শমাত্রই অনুভূত হয় ইতিহাস, বিজয়, গৌরব, শান-শওকত, অত্যাচার, পরাধীনতা, গ্লানি কিংবা নীরবে ঝরে যাওয়া অশ্রুজল। কান পাতলে যেন আজও শোনা যায় সেই সময়ের মুঘল কথোপকথন।

উত্তর প্রদেশের আগ্রায় ১৫৬৯ সালে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনকালে নির্মিত হয় ফতেপুর সিক্রি।  ১৫৭১ থেকে ১৫৮৫ পর্যন্ত মুঘল রাজধানী ছিল এই সিক্রি। লাল বেলেপাথরে তৈরি প্রাসাদ নগরীর স্থাপত্যশৈলী হিন্দু-মুসলিম ঘরানার।

ফতেপুর সিক্রি। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

ফতেপুর সিক্রির বাংলা অর্থ দাঁড়ায় 'বিজয় নগরী'। মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও স্থাপত্যশৈলীর তাৎপর্যের নিরিখে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ফতেপুর সিক্রি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকাভুক্ত হয়।

সন্তানহীন মুঘল সম্রাট আকবর বংশধরের আশায় ফতেপুর এসেছিলেন সুফিসাধক সেলিম চিশতীর কাছে। তার দোয়ায় হিন্দু রানী যোধাবাঈ জন্ম দেন পুত্র সন্তান সেলিমের। সেলিম পরবর্তী মুঘল শাসক হিসেবে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন, যিনি সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে পরিচিত। মুসলিম রানী রোকাইয়া বেগম ও খ্রিস্টান রানী মারিয়মের গর্ভেও সন্তান আসে।

সুফি সাধক সেলিম চিশতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই সম্রাট আকবর নির্মাণ করেন ফতেপুর সিক্রি। ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর মাঝে পারস্য কারুকার্যের ছোঁয়া এই নগরীকে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়। 

জামে মসজিদ। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

যা আছে ফতেপুর সিক্রিতে

পাথুরে উঠোন, বেলেপাথরের দেয়াল এবং সম্পূর্ণ হাতের কারুকার্যে সাজানো যেন এক প্রাসাদনগরী, যার কেন্দ্রে শোভাবর্ধন করছে শ্বেতপাথরে মোড়া সেলিম চিশতির সমাধি। আজও জীবন্ত এই ঐতিহাসিক মুঘল নগরী তার নিজ সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র্যের কারণে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে।

বুলন্দ দরওয়াজা

বুলন্দ দরওয়াজা। ছবি: সোমনাথ দত্ত

গুজরাট জয়ের প্রতীক হিসেবে ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের নির্মাণ করা ৫৪ মিটার উঁচু বুলন্দ দরওয়াজা বিশ্বের উচ্চতম প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত। ফতেপুর সিক্রিতে প্রবেশের মূল দরজা এটি। লাল ও হলুদ বেলেপাথরে দরজার কাঠামো, পাল্লায় কাঠের কারুকাজ। অপরূপ নকশাখচিত বুলন্দ দরওয়াজা সৌন্দর্য আর ইতিহাসকে একসঙ্গে ধারণ করে আছে সগৌরবে। দরজার পূর্বদিকের খিলানে পারস্য লিপিতে লেখা রয়েছে মুঘল সম্রাট আকবরের গুজরাট বিজয়ের কথা। বাদশাহি দরওয়াজা নামেও আরেকটি দ্বার রয়েছে এখানে।

জামে মসজিদ

জামে মসজিদ। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

বুলন্দ দরওয়াজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে জামে মসজিদ। ১৬ শতকের এই মসজিদ ভারতের বৃহত্তম মসজিদগুলোর একটি, যেখানে সহস্রাধিক মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের নকশায় পারস্য স্থাপত্য প্রতিফলিত হয়েছে। 

সেলিম চিশতির মাজার

ফতেপুর সিক্রির মসজিদ চত্বরেই শ্বেতপাথরে তৈরি সেলিম চিশতির দরগা। সুফিসাধক সেলিম চিশতির ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পুত্রলাভ করেছিলেন সম্রাট আকবর। তার স্মরণে সমাধিটি প্রথমে সম্রাট আকবর লাল বেলেপাথরে নির্মাণ করেন। পরে পুরোটাই শ্বেতপাথরে ঢেকে দেন জাহাঙ্গীর। 

মনের ইচ্ছে জানাতে সেলিম চিশতির সমাধিতে চাদর এবং ফুল ছড়াতে প্রচুর মানুষের সমাগম হয় প্রতিদিন। ধর্মীয় ভাবাবেগ এবং পবিত্র মনে শ্রদ্ধা ও ভক্তি নিবেদন চলে প্রতিনিয়ত।

সেলিম চিশতির মাজার। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

আনারকলির জীবন্ত কবর বা সুড়ঙ্গ

যুবরাজ সেলিম ও আনারকলির অসমাপ্ত প্রেমকাহিনী সবারই জানা। ঐতিহাসিকদের মতে, সম্রাট আকবরের নির্দেশে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল আনারকলিকে। আবার কেউ কেউ মনে করেন ওই স্থানের ভেতরের সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল আনারকলি। এই অসমাপ্ত প্রেমকাহিনী আজও মানুষের কাছে এক রহস্যজনক অধ্যায়। তবে দর্শনার্থীদের কাছে এই রহস্যজনক সুড়ঙ্গ-দ্বার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

আনারকলির জীবন্ত কবর বা সুড়ঙ্গ। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

ফতেপুর থেকে বেরিয়ে একটু দূরেই আবার যোধা আকবরের রাজপ্রাসাদ যা সিক্রির অন্তর্গত। সেখানে গেলেও দেখা যাবে ইতিহাসের অনন্য কিছু নিদর্শন।

বীরবলের প্রাসাদ

মূল প্রবেশপথ পেরোলেই চোখে পড়বে বীরবলের প্রাসাদ। অসাধারণ রসবোধ, দূরদৃষ্টি ও মেধার কারণে বীরবল ছিলেন সম্রাট আকবরের বিশ্বস্ত প্রিয়ভাজন। প্রধান পরামর্শদাতা উজির বীরবলের জন্য আকবর নিজের প্রাসাদ চত্বরেই ছোট্ট এক প্রাসাদ তৈরি করেন, যা আজও অটুট।

বীরবলের প্রাসাদ। ছবি: সোমনাথ দত্ত

আস্তাবল ও মীনাবাজার

বীরবলের প্রাসাদের পাশেই সম্রাট আকবরের বিরাট আস্তাবল, যেখানে হাতি ও ঘোড়া রাখা হতো। এর পাশে নহবৎখানা ও মীনাবাজার। নহবতের আসরে বাদ্য-বাজনা, আমোদ-প্রমোদে এক খুশির আমেজ বিরাজ করত নগরীতে। মীনাবাজারে বাজার বসত রাণীদের জন্য।

আস্তাবল ও মীনাবাজার। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

হাম্মামখানা

রাজপরিবারের নারীদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি এই স্নানাগার আজও অক্ষত।

হাম্মামখানা। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

পাঁচমহল বা পঞ্চমহল

পাঁচ স্তরের প্রাসাদ, অপূর্ব নির্মাণশৈলী ও নকশার প্রকৌশল আজও পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এটি বিশ্রাম ও বিনোদনের জন্য ব্যবহার করা হতো। বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবও পালন করতেন ভিন্ন ধর্মের তিন রাণী।

পাঁচমহল বা পঞ্চমহল। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

অনুপ তালাও

সিক্রিতে আকবরের প্রাসাদের পাশে জলবেষ্টিত 'অনুপ তালাও'য়ে এ বসে বীণা বাজাতেন তানসেন। সম্রাট আকবরের নবরত্নদের মধ্যে অন্যতম এবং সর্বকালের সেরা সঙ্গীতজ্ঞ তানসেনের বীণার ঝঙ্কারে শুধু মানুষ নয় সাড়া দিত প্রকৃতিও।

অনুপ তালাও। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

যোধাবাঈয়ের প্রাসাদ

সিক্রিতে মুঘল সম্রাজ্ঞী হিন্দু রানী যোধাবাঈয়ের মহল গুজরাটি কারুকাজের এক অমূল্য নিদর্শন। এর কাঠামো এবং কারুকাজ নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর। লাল বেলেপাথরের প্রাসাদে গরম এবং শীতকালের জন্য আলাদা শয়নকক্ষ ছিল যোধাবাঈয়ের জন্য। হিন্দু রানীর সম্মানে প্রাসাদের ভেতরে মন্দির তৈরি করেছিলেন সম্রাট আকবর। প্রাসাদের আঙিনায় ছিল তুলসিমঞ্চ, যা আজও বিদ্যমান।

সিক্রিতে যোধাবাঈয়ের রাজপ্রাসাদ। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

এছাড়াও গোয়ার শৈলীতে খ্রিস্টান বেগম মারিয়মের গোল্ডেন প্যালেস এবং কাশ্মীরী শৈলীতে করা সুলতানা রোকাইয়ার মহল রয়েছে সিক্রিতে। রাজপরিবারের ভোজনালয়, দেওয়ান-ই-খাস, দেওয়ান-ই-আম ছাড়াও আরও অনেক নিদর্শন রয়েছে ফতেপুর সিক্রিতে। প্রাসাদের উপর থেকে চারিদিকের সৌন্দর্য ইতিহাসকে হাতছানি দেয়।

ফতেপুর সিক্রি ভ্রমণের সেরা সময় 

ফতেপুর সিক্রি। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

যদিও অধিকাংশ দর্শনার্থীদের কাছে আগ্রার মূল আকর্ষণ তাজমহল, কিন্তু যারা ইতিহাস ঘেঁটেছেন তাদের কাছে ফতেপুর সিক্রিও তাজমহলের মতোই সমান আকর্ষণীয়।

সারাবছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে এখানে। তবে অক্টোবর থেকে মার্চ মাস ফতেপুর সিক্রি ভ্রমণের উত্তম সময়। ফতেপুর ও সিক্রি উভয় স্থানের জন্য রয়েছে আলাদা প্রবেশমূল্য। দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের জন্য উভয়ক্ষেত্রেই তা ভিন্ন।

যেভাবে যাবেন

ভারতে ভ্রমণের ভিসা থাকা বাধ্যতামূলক। রেলপথে কলকাতার শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশন থেকে আগ্রা যাওয়ার সরাসরি ট্রেন আছে। এছাড়াও ট্রেনে কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে আগ্রা যাওয়ার ট্রেন আছে।

উড়োজাহাজে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি নয়াদিল্লি গিয়ে সেখান থেকেও ট্রেন কিংবা বাসে আগ্রা যাওয়া যেতে পারে।

আগ্রা থেকে প্রাইভেট ক্যাব অথবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা বুক করে একদিনেই অনায়াসে ঘুরে আসতে পারেন ফতেপুর সিক্রি।

দৌলতখানা। ছবি: স্মৃতি মন্ডল

থাকবেন যেখানে

ফতেপুর সিক্রিতে রাত্রিযাপনের দরকার পড়ে না। আগ্রা থেকে একদিনেই ঘুরে আসা সম্ভব ফতেপুর সিক্রি। আগ্রায় সব ধরনের হোটেল পেয়ে যাবেন চাহিদা অনুযায়ী।  অনলাইন ও অফলাইন দুইভাবেই হোটেল বুক করতে পারবেন।

মনে রাখা জরুরি

বাজেট ও পছন্দ অনুযায়ী নির্দিষ্ট গাইড বেছে নিয়ে ভ্রমণ করলে তা হবে সুখকর ও ফলপ্রদ।

সব দেশের সব ধর্মের মানুষের প্রবেশাধিকার থাকলেও, ফতেপুর মসজিদের ভেতরে হাফপ্যান্ট কিংবা দৃষ্টিকটু পোশাক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। 

সঙ্গে পর্যাপ্ত পানীয় জল রাখা আবশ্যক। ফতেপুর সিক্রি পুরোটাই পাথরের তৈরি হওয়ায় সেখানকার তাপমাত্রা সম্পূর্ণ ভিন্ন। রোদ থেকে বাঁচতে সানগ্লাস ও টুপি  ব্যবহার করতে পারেন।
 

Comments