যুক্তরাষ্ট্রের লেক্সিংটন শহর, সান্ধ্যকালীন আড্ডা আর সুস্বাদু যত কুইজিন

পূর্ব-এশিয়ার কুইজিন মানেই তো সুশি, কিমচি বা সি-ফুড দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার। তবে দেশের রেস্তোরাঁগুলোতে সুশি বা পূর্ব-এশিয়ার খাবার যতটা ব্যয়বহুল, যুক্তরাষ্ট্রে মোটেও তেমনটা নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের খাবার
ছবি: নাদিয়া রহমান

যুক্তরাষ্ট্রে আমরা যারা পড়তে যাই, সপ্তাহের প্রতিটা দিন তাদের বিভিন্ন ব্যস্ততা থাকবে এমনটাই স্বাভাবিক। বরং ব্যস্ততা না থাকলেই আমাদের, ডর্মে থাকা শিক্ষার্থীদের মনে হয়েছে আজ দিনটা এমন কেন!

তো এই ব্যস্ততার মাঝে বা যেদিনই সময় মিলত, আমাদের তালিকায় থাকত কেন্টাকির লেক্সিংটন শহরের বিভিন্ন ক্যাফে এবং রেস্তোরাঁয় যাওয়া এবং দেশ-বিদেশের কুইজিন পরখ করা। বলে রাখি, আমরা যেমন খাবার আর মশলার সঙ্গে অভ্যস্ত, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটে সেটা নাও মিলতে পারে।

'কশার' বা হালালের বিষয়টাও থাকে। তাই দক্ষিণ এশিয়া কিংবা ধর্ম এবং নিজস্ব রীতিনীতির দিক থেকে কয়েকটি রেস্তোরাঁ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এ তালিকায় প্রথমেই আছে মেডিটেরানিয়ান রেস্তোরাঁ।

মেডিটেরানিয়ান রেস্তোরাঁ

ভূমধ্যসাগরবর্তী দেশগুলোর এসব রেস্তোরাঁ মুসলিম শিক্ষার্থী এবং যারা খাবারে 'কশার' বিষয়টি মেনে চলেন, তাদের জন্য এক কথায় ঝামেলাবিহীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আয়োজনেও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে এসব মেডিটেরানিয়ান রেস্তোরাঁ থেকে খাবার আনা হতো।

যুক্তরাষ্ট্রের খাবার
ছবি: নাদিয়া রহমান

যাই হোক, মেডিটেরানিয়ান খাবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো বিভিন্ন মশলায় পোড়ানো মাংস এবং সঙ্গে বেশ ভালো পরিমাণে স্যালাড। স্যালাডের অন্যতম উপকরণ 'ফেটা চিজ' আর অলিভ (জলপাই)। প্রথমে বুঝতে না পেরে অনেক স্যালাড নিয়ে পরে গাঁটের টাকা জলে ফেলতে হয়েছে। সাধারণত স্যালাডে ফেটা চিজ আর অলিভ দেওয়ায় স্বাদ এমন টক হয়ে যায়, যা আসলে পুরোটা খাওয়া দুরূহ। আমরা যারা বাংলাদেশ কিংবা এশিয়া থেকে গিয়েছি, একেবারে দেশীয় স্বাদ খুঁজে না পাওয়ায় এই মেডিটেরানিয়ান রেস্তোরাঁর খাবার আমাদের কাছে ছিল অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো।

পূর্ব-এশিয়ার কুইজিন

পূর্ব-এশিয়ার কুইজিন মানেই তো সুশি, কিমচি বা সি-ফুড দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার। তবে দেশের রেস্তোরাঁগুলোতে সুশি বা পূর্ব-এশিয়ার খাবার যতটা ব্যয়বহুল যুক্তরাষ্ট্রে মোটেও তেমনটা নয়। ৬ ডলার থেকে শুরু হয় একেকটি সুশি বক্স। কখনও সপ্তাহের কোনো নির্দিষ্ট দিনে এর দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। মেডিটেরানিয়ান খাবার অন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মতো আমার পছন্দ তালিকায় কখনোই ছিল না। এ তালিকায় জাপান কিংবা কোরিয়ার কুইজিনই ছিল বরাবর এগিয়ে।

'হ্যাপি সুশি',  'হিবাচি', 'হা নো রি' এই তিনটি ছিল আমার সবচেয়ে পছন্দের। একে তো খাবারের অনেক বৈচিত্র্য, তার মধ্যে খরচাও ছিল আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের সাধ্যের ভেতর। পূর্ব-এশিয়ার নিজস্ব 'হট-পট' কায়দায় পরিবেশনের বিষয়টা ছিল বেশ ঘরোয়া আমেজের।

যদিও ধোঁয়া উঠতে থাকা মাংসে কী মশলা যোগ করা হবে, কতখানি সয়া সস দেওয়া উচিত এসবের পরিমাণে ভুল হতোই। তবে নিজ হাতে নিজের ইচ্ছেমতো মশলাপাতি যোগ করার একটা কাজ পাওয়া যেত কোরিয়ার কিছু রেস্তোরাঁয়।

খাবার ছাড়াও সন্ধ্যায় রেস্তোরাঁগুলোর আলো, তাদের নিজ দেশীয় কায়দায় সাজানো পরিবেশ আর রেস্তোরাঁর লোকদের ব্যবহার ছিল অমায়িক। এ সব রেস্তোরাঁয় গেলে মনে হতো না কোনো খাবারের দোকানে আসা হয়েছে। সারা সপ্তাহ পর বন্ধুদের সঙ্গে হালকা হলদে আলোয় গা এলিয়ে বসে সামনে খাবার আর গল্প করার আমেজ ছিল বেশ আমুদে।

যেই বিষয়টি আরও ভাল লাগত, আমাদের খাবার শেষ হয়ে গেলেও আমরা আরও ঘণ্টা দুয়েক বসে গল্পে মশগুল হলেও কেউ আমাদের এসে উঠে যেতে বলেনি। বরং জিজ্ঞেস করা হয়েছে, রেস্তোরাঁয় এই সান্ধ্যকালীন সময়ে অন্য কোনো গানের সুর দেওয়া হবে কি না!

আবারও সেই দক্ষিণ এশিয়া

লেক্সিংটন শহরে পুরোদস্তুর বাংলাদেশের খাবারের দেখা মেলেনি। তাই বাঙালির বিরিয়ানি, মিষ্টি বা দেশীয় কারি, এসবের খোঁজে যাওয়া হতো নেপাল, ভারত, আফগানের রেস্তোরাঁয়। আফগান দেশের খাবার অনেকটা মেডিটেরানিয়ান দোকানগুলোর মতোই। হয়তো মশলা এবং তিন-চারটি পদের পার্থক্য আছে।

নেপালের যেই রেস্তোরাঁটিতে আমাদের যাওয়া হতো তা হলো মাউন্ট এভারেস্ট। তবে আমরা দেশে যে স্বাদের নেপালের খাবার খেয়ে অভ্যস্ত, তার বেশিরভাগই মিলবে না এখানকার সঙ্গে। সেটা নুডলস, থুকপা থেকে শুরু করে মোমোই হোক আর অন্য কোনো তরকারিই হোক। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের যে কয়েকটি খাবারের দোকানেই যাওয়া হয়েছে, বরাবরই মনে হয়েছে 'এ কেমন অদ্ভুত স্বাদ!'

এখানে বিষয় হলো, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের খাবারের নিজস্বতা। যেমন হায়দরাবাদ, গুজরাটের নিজস্ব কায়দায় একেক রকমের স্বাদ। 'হায়দরাবাদ বিরিয়ানি হাউজের' হালিম বা শহরতলির পালং-পনির খেয়ে হয়তো যে কারোরই মনে হবে, ভুল করে এর নামকরণ এমনটি রাখা হয়েছে।

তবে লেক্সিংটনের পুরো শহর জুড়ে আরও বিভিন্ন দেশের রেস্তোরাঁ রয়েছে। লাতিনের মধ্যে কিউডোবার অ্যাভোক্যাডো স্যালাড আর ন্যাচোস ছিল আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পছন্দের খাবার। কিছু আফ্রিকা মহাদেশের রেস্তোরাঁ আছে, যেখানে 'যলোফ রাইস' আর ডেজার্ট খেয়ে মনে হবে দেশীয় খাবােই যেন।

আর পূর্ব-এশিয়া ছেড়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে এগুলে মিলবে থাইল্যান্ডের 'প্যাড থাই', আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আরেকটি পছন্দের রেস্তোরাঁ। এই রেস্তোরাঁর প্রতিটি খাবারই মনে করিয়ে দেবে, আপনি খাবারটি অর্ডার করে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন!

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

 

   

Comments